সবাই একে অপরের কাছে অচেনা, কিন্তু একটি পরিচয়ে একাত্ম রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মত। তারা যে পথ ধরে চলে—মিনা, আরাফা, মুযদালিফা, কাবার তাওয়াফ, সাফা-মারওয়ার সাঈ এসব পথ, এসব ময়দান কোনো সাধারণ ভ্রমণপথ নয়। এই পথে একদিন রক্তাক্ত পায়ে হেঁটেছিলেন আল্লাহর রাসল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, যার কষ্ট, কান্না ও দুআয় গড়ে উঠেছে আজকের ইসলামি সভ্যতা।
মক্কার গলিতে পাথরের জমিতে দাওয়াতের পদচিহ্ন
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৪০ বছর বয়সে নবুওয়াত লাভের পর মক্কার মানুষকে একত্ববাদে ডাকার জন্য বেরিয়ে পড়েন। কুরাইশদের অলি-গলি, উঁচু-নিচু পাথুরে জমি সবখানে পায়ে হেঁটে তিনি দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন। মানুষ তাঁকে উপহাস করেছে, পাথর ছুঁড়েছে, ধুলো ছিটিয়েছে, অথচ তিনি কখনো দমে যাননি।
তিনি বলতেন,
হে আমার জাতি! বলো, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’—তাহলে তোমরা মুক্তি পাবে। (মুসনাদু আহমাদ: ৩৭৭)
একদিন কাবার পাশে নামাজ পড়ছিলেন, এমন সময় উটের নাড়িভুঁড়ি এনে তাঁর পিঠে ফেলে দেওয়া হয় (সহিহ বুখারি: ২৪০)। সেই কষ্টের শহরেই আজ হাজিরা চোখের জলে তাওয়াফ করেন।
আরও পড়ুন: নিজের হাতে হালাল উপার্জনই আল্লাহর কাছে প্রিয়
তায়েফের পথে রক্তের ছাপ
মক্কায় নির্যাতন যখন চরমে পৌঁছায়, তখন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশ্রয় খুঁজতে যান তায়েফে। কিন্তু সেখানেও তাকে পাথর ছুঁড়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। তাঁর পা রক্তাক্ত হয়। তিনি একটি বাগানে আশ্রয় নেন এবং কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহর কাছে দুআ করেন,
হে আল্লাহ! আমি আমার দুর্বলতা, শক্তির অভাব এবং মানুষের কাছে আমার হেয় অবস্থার অভিযোগ করছি (সিরাতু ইবনি হিশাম, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৪২০)
আজ সেই দাওয়াতের ধারা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে, আর সেই কষ্টের পথেই হেঁটে যায় লক্ষ লক্ষ হাজিরা।
সাফা-মারওয়ায় দাওয়াতের সূচনা
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামের দাওয়াত শুরু করেন সাফা পাহাড়ে দাঁড়িয়ে। তিনি লোকজনকে জড়ো করে বলেন,
আমি যদি বলি, পাহাড়ের পেছনে শত্রু আছে, তোমরা কি বিশ্বাস করবে? লোকে বলল, অবশ্যই। তিনি বললেন, তাহলে শুনো, আমি তোমাদের সামনে এক কঠিন শাস্তির সতর্ককারী। (সহিহ বুখারি: ৪৯৭১)
আজ সেই সাফা ও মারওয়ার মধ্যেই হাজিরা সাঈ করেন, নবিজির দাওয়াতের সেই প্রথম উচ্চারণ স্মরণ করেন।
আরাফায় দোয়া, বিদায়ের আহ্বান
বিদায় হজে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরাফার ময়দানে দাঁড়িয়ে বলেন,
আজ আমি তোমাদের জন্য দ্বীনকে পূর্ণ করে দিলাম, আমার নিআমত তোমাদের ওপর সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করলাম। (সুরা মায়েদা:৩)
এই ঐতিহাসিক ঘোষণার ময়দানেই আজ লক্ষ হাজি কান্নাভেজা চোখে হাত তুলে দুআ করেন—সেই একই জমিন, সেই একই আকাশের নিচে।
মিনা, মুযদালিফা প্রতিটি ধাপে রাসুলের স্মৃতি
রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিনায় রাত কাটিয়েছেন, মুযদালিফায় বিশ্রাম নিয়েছেন, শয়তানের প্রতি রমি করেছেন, কুরবানি করেছেন। হাজিরা আজ প্রতিটি ধাপে সেই কাজই করছেন, যা একদিন করেছেন আল্লাহর প্রিয় রসুল।
আজকের হজ: শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, এক অনুভূতির সফর
হজে যাওয়া মানে শুধু ফরজ আদায় নয়, বরং রাসুলের পদচিহ্ন অনুসরণ করা। সেই পদচিহ্নে আছে কষ্ট, ধৈর্য, ত্যাগ ও ভালোবাসা। একজন হাজি যখন তাওয়াফ করেন, সাঈ করেন, আরাফায় দাঁড়ান—তখন তিনি নবিজির সেই দীর্ঘ সংগ্রামকেই স্মরণ করেন।
]]>