দ্বিতীয় আকাবা চুক্তির প্রেক্ষাপট
মক্কার প্রাথমিক যুগে মুসলমানরা তীব্র নির্যাতনের মুখে পড়েছিল। একদিকে কুরাইশদের নির্মম শাস্তি, অন্যদিকে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে নিঃসঙ্গতা,সব মিলিয়ে দাওয়াতের অগ্রগতি থমকে যাচ্ছিল। এই সময়ে রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজের মৌসুমে আরবের বিভিন্ন গোত্রের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দিতেন।
প্রথম আকাবা চুক্তি (১১ হিজরী পূর্বে ৬২১ খ্রিষ্টাব্দে) ইয়াসরিবের ছয়জন লোকের হাতে সম্পন্ন হয়। তারা নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম–এর কাছে ইসলাম গ্রহণ করে এবং ইয়াসরিবে দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এরপর পরবর্তী বছর আরও ১২জন ইয়াসরিববাসী এসে ইসলাম গ্রহণ করে। অবশেষে ১৩ হিজরী পূর্বে, হজ মৌসুমে, ৭৩ জন পুরুষ ও ২ জন নারী মক্কায় এসে নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম–এর সঙ্গে দ্বিতীয় আকাবা চুক্তি সম্পাদন করেন।
আবু হুরায়রা রা.বর্ণিত; নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
تُبَايِعُونِي عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ فِي النَّشَاطِ وَالْكَسَلِ، وَالنَّفَقَةِ فِي الْعُسْرِ وَالْيُسْرِ، وَعَلَى الْأَمْرِ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّهْيِ عَنِ الْمُنْكَرِ، وَأَنْ تَقُومُوا فِي اللَّهِ لَا تَأْخُذُكُمْ فِي اللَّهِ لَوْمَةُ لَائِمٍ، وَعَلَى أَنْ تَنْصُرُونِي إِذَا قَدِمْتُ عَلَيْكُمْ، وَتَمْنَعُونِي مِمَّا تَمْنَعُونَ مِنْهُ أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ. তোমরা আমার হাতে বায়আত করছো এ শর্তে যে, তোমরা সক্রিয় অবস্থায় এবং অলস অবস্থায় (যে পরিস্থিতিই হোক না কেন) আমার কথা শুনবে এবং মানবে, এবং সচ্ছলতা ও অভাব,উভয় অবস্থায় ব্যয় করবে, এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে, এবং আল্লাহর পথে দৃঢ় থাকবে, আল্লাহর ব্যাপারে কোনো নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় করবে না, এবং যখন আমি তোমাদের নিকট আগমন করব, তখন তোমরা আমাকে সাহায্য করবে, এবং যেভাবে তোমরা নিজেদের ও তোমাদের পরিবারকে রক্ষা কর, সেভাবেই আমাকে রক্ষা করবে।
(সহিহ মুসলিম:১৭০৯)
ইয়াসরিবের লোকদের আগমন
হজের মৌসুমে ইয়াসরিবের ৭৩ জন পুরুষ ও ২ জন নারী গোপনে মক্কায় এসে নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম–এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা রাতের আঁধারে আকাবা পাহাড়ের গোপন স্থানে সমবেত হন। ইসলামের ইতিহাসে এই সমাবেশের তাৎপর্য অপরিসীম, কারণ তারা শুধু ইসলাম গ্রহণ করেননি, বরং নিজেদের জীবন, সম্পদ ও পরিবারকে ত্যাগ করে নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম–কে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন।
আরও পড়ুন: নবীজির প্রতি দরুদ পাঠের ৫ ফজিলত
ইবনু হিশাম রহ. তার আস-সিরাতুন্নবাবিয়্যাহ,তে উল্লেখ করেছেন,
ইয়াসরিববাসীরা বললেন, হে আল্লাহর রসুল! আমরা আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করবো, যেমন আমরা আমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য যুদ্ধ করি। এই প্রতিশ্রুতি ছিল তাদের ঈমানের দৃঢ়তার এক জীবন্ত দলিল।
বায়আত ও প্রতিশ্রুতির শর্তাবলি
দ্বিতীয় আকাবা চুক্তি শুধু একটি অঙ্গীকার ছিল না; এটি ছিল ঈমান, ত্যাগ ও দায়িত্বের প্রতিশ্রুতি। নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কয়েকটি মূল শর্তে বায়আত নিলে,
বায়আতের প্রধান শর্তগুলো ছিল,
১. আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক না করা। ২. চুরি, ব্যভিচার ও হত্যাকাণ্ড থেকে বিরত থাকা। ৩.নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম–এর সুরক্ষা করা। ৪. সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং মিথ্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। ৫. নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম–এর দাওয়াত প্রচারে সর্বশক্তি নিয়োগ করা।
আবু হুরায়রা রা.বর্ণিত; নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
تُبَايِعُونِي عَلَى أَنْ لَا تُشْرِكُوا بِاللَّهِ شَيْئًا وَلَا تَسْرِقُوا وَلَا تَزْنُوا وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ وَلَا تَأْتُوا بِبُهْتَانٍ، وَلَا تَعْصُوا فِي مَعْرُوفٍ، فَمَنْ وَفَى مِنْكُمْ فَأَجْرُهُ عَلَى اللَّهِ. তোমরা আমার সঙ্গে এই মর্মে বায়আত করো যে, তোমরা আল্লাহর সঙ্গে কোনো কিছু শরিক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না, ইচ্ছাকৃতভাবে কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ আনবে না, এবং কোনো সৎকাজে আমার অবাধ্যতা করবে না। তোমাদের মধ্যে যে এই অঙ্গীকার পূর্ণ করবে, তার প্রতিদান আল্লাহর কাছে নির্ধারিত থাকবে। (সহিহ বুখারি:১৮)
দ্বিতীয় আকাবা চুক্তির পর ইসলামের দাওয়াত নতুন গতিপথ লাভ করে। ইয়াসরিবে দাওয়াত আরও শক্তিশালী হয়, এবং নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম–এর নির্দেশে সেখানে মুসআব ইবনু উমায়ের রা.কে পাঠানো হয়, যিনি ইসলামের প্রথম দূত হিসেবে পরিচিত। তার প্রচেষ্টায় ইয়াসরিবে ইসলাম দ্রুত বিস্তার লাভ করে। এ চুক্তির মাধ্যমেই আল্লাহর নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম–এর জন্য মদিনায় হিজরতের পথ সুগম হয়। ইয়াসরিব পরবর্তীতে মদিনাতুন নবী (নবীজির শহর) হিসেবে পরিচিত হয়, যেখানে ইসলাম তার শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করে এবং পরবর্তীতে সমগ্র আরব জুড়ে আলো ছড়িয়ে দেয়।
দ্বিতীয় আকাবা চুক্তি ইসলামের ইতিহাসে একটি মোড় পরিবর্তনের মুহূর্ত। ইয়াসরিবের সাধারণ কিছু মানুষ তাদের ঈমানের শক্তিতে ইসলামের পতাকা উঁচু করেছিলেন। তাদের সেই ত্যাগ ও সাহস আজও আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। এ চুক্তিই মদিনায় ইসলামি সমাজব্যবস্থার সূচনা করে এবং পরবর্তী সময়ে ইসলামের বৈশ্বিক প্রসারের পথ প্রশস্ত করে।