এক সময়ের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী মনোরঞ্জন সাহা এখন রাস্তার পাশের ব্রোকার। পণ্য বিক্রির পাওনা ১৫ কোটি টাকা ফেরত না পেলেও ৯ কোটির টাকা দেনা শোধ করতে হয়েছে নিজের মালিকানাধীন বহুতল ভবন বিক্রি করে।
প্রতারণার শিকার ব্যবসায়ী মনোরঞ্জন সাহা বলেন, ‘বিল্ডিং বিক্রি করে ৯ কোটি টাকা দেনা শোধ করেছি। কিন্তু আমি লাইন থেকে ১৫ কোটি টাকার এক টাকাও ফেরত পাইনি। আমাকে এখন পথের ফকির হিসেবে ধরা যায়। আমি এখন ব্রোকারি করে চলছি।’
দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি ভোগ্য পণ্যের বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে মনোরঞ্জন একা নয়, তার মতো শত শত ব্যবসায়ী প্রতারকদের কাছে টাকা হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। মূলত কম সময়ে বেশি লাভের আশায় কথিত ডিও এবং স্লিপ ব্যবসায়ীর কবলে পড়ছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা। ভোজ্য তেল-চিনি এবং মসলা বেচা-কেনার ক্ষেত্রে ডিও ব্যবসা বেশি হওয়ায় এগুলোতে প্রতারণাও বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে।
আরও পড়ুন: সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজারে যেভাবে বাড়ে পণ্যের দাম
চট্টগ্রাম জেলার খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ী জাফর আহমেদ বলেন, ‘বাজারে দেড় কোটি টাকার পণ্য বাকিতে দিচ্ছে, পরে দেখা যায়, বাজার দর কমে গেছে, পণ্য বিক্রি করতে পারছেন না। তাহলে যিনি দেড় কোটি টাকা দিয়ে বাকিতে পণ্য কিনেছেন, তিনি টাকা দেবেন কি করে? পরে লোকসানে পণ্য বিক্রি করে ওই টাকা শোধ করতে হয়। সেটাও না পারলে সুদের ওপর টাকা নিয়ে ওই দেনা পরিশোধ করতে হয়।’
চট্টগ্রাম জেলার খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ী আব্বাস আলী বলেন, ‘অসাধু কিছু ব্যবসায়ী আছেন; তাদের উদ্দেশ্য ব্যবসা না, মানুষের বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে প্রতারণা করা।’
খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৬ সালে বিভূতি রায় নামে এক ব্যবসায়ী ৬ কোটি টাকা নিয়ে পালানোর পর থেকে শুরু হয় প্রতারণার নতুন এই পদ্ধতি। সবশেষ ৫০ কোটি টাকার বেশি নিয়ে লাপাত্তা নূর ট্রেডিং নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। অবশ্য এরআগে চৌধুরী ব্রাদার্স ১৪৮ কোটি, মৌলভী আলম কোটি, শাহ জামাল ৫০ কোটি, মোহাম্মদ আলী ৪৭ কোটি, শাহজাহান ট্রেডার্স ২৪ কোটি, আবসার-মুছা ব্রাদার্স ২১ কোটি, নুরুল আলম চৌধুরী ২০ কোটি এবং এম রহমান ১২ কোটি টাকা নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে।
আরও পড়ুন: ১৫০০ টাকার এলাচ ৪৫০০ টাকায় বিক্রি!
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার কল্যাণ সমিতি সভাপতি মো. খোরশেদ আলম বলেন, যারা ডিও ব্যবসা করেন তাদের কোনো মালামাল দেখা যাচ্ছে না। তারা শুধু স্লিপের মাধ্যমে কোম্পানির সঙ্গে লেনদেন করছেন। এটার মধ্যে কাজ করতে গিয়ে অনেকেই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।
খাতুনগঞ্জ মেসার্স আলতাফ অ্যান্ড ব্রাদার্সের মালিক মুহাম্মদ আলতাফ এ গাফ্ফার বলেন, ‘অসাধু ব্যবসায়ীরা প্রথম দিকে নগদে লেনদেন করেন। বিশ্বস্ততা অর্জন করে পরে তারা বাকিতে নেয়া শুরু করেন। এরা আসলে পাতানো ব্যবসা করে প্রতারণা করেন।’
ব্যবসায়ীক প্রাণকেন্দ্র চাক্তাই-আছাদগঞ্জ এবং খাতুনগঞ্জে ৫ হাজারের বেশি ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও পণ্য রাখার গুদাম রয়েছে। এখানে সবগুলো সরকারি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা থাকলেও নিজেদের মধ্যে নগদ টাকা লেনদেন করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন ব্যবসায়ীরা। আবার ব্যবসায়ী সমিতির মাধ্যমে টাকা আদায়ের চেষ্টা করায় ভুক্তভোগীরা অনেকক্ষেত্রে মামলা করতে আগ্রহী নন বলে জানায় পুলিশ।
আরও পড়ুন: আগুন লাগতেই রাতের আঁধারে বেড়ে গেল চিনির দাম!
সিএমপির উপ-কমিশনার শাকিলা সোলতানা বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের নিজেদের যে সমস্যাগুলো হয়, সেগুলো তারা নিজেরাই সমাধান করেন। তারা পুলিশের কাছে আসেন না। যদি কোনো বাদী আমাদের কাছে আসেন তাহলে অবশ্যই আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব।’
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার কল্যাণ সমিতি সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, ‘এ যাবৎ অনেকে প্রতারণা শিকার হয়েছেন। এখন পর্যন্ত কারও কোনো বিচার হয়নি। আমার নিজেরও অনেক মামলা আছে, রায়ও হয়েছে; কিন্তু টাকা পাচ্ছি না।’
এক থেকে ১০ কোটি টাকা নিয়ে গা ঢাকা দেয়া ব্যবসায়ীর সংখ্যা অন্তত ৭০ জন বলে জানিয়েছেন প্রতারণার শিকার ব্যবসায়ীরা।