১৯৮৩ সালে তৎকালীন জাতীয় পার্টি সরকারের সময়ে জেলা পরিষদের অর্থায়নে শহরের দড়িপাড়া এলাকায় ২ একর ৮৮ শতাংশ জমির ওপর নির্মিত হয় এ টার্মিনালটি। একতলা বিশিষ্ট ভবনের নির্মাণ ব্যয় ছিল মাত্র ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এরপর কেটে গেছে চার দশক, তবুও হয়নি কোনো বড় সংস্কার কাজ। বর্তমানে যাত্রীরা যেমন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন, তেমনি চালক-শ্রমিকরাও অসহনীয় পরিবেশে প্রতিদিন কাজ করছেন।
টার্মিনালের মূল ভবনজুড়ে রয়েছে ফাটল ও ছাদ ভেঙে পড়ার আশঙ্কা। দেয়ালগুলো ঝুরঝুরে। কোনো যাত্রী ছাউনি নেই, নেই বিশ্রামাগার, খাবার হোটেল কিংবা শৌচাগার। পুরো এলাকাজুড়ে কাদা-পানি জমে থাকা, ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধ আর উন্মুক্ত নালার কারণে অসহনীয় অবস্থা তৈরি হয়েছে। ভেতরে বাস প্রবেশ করে না, যাত্রীদের রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে উঠতে-নামতে হয়। বৃষ্টির দিনে মাটি কাদায় পরিণত হলে চলাফেরা করাও হয়ে পড়ে দুঃসাধ্য।
বাস চালক ফরমান খান বলেন, বাংলাদেশের কোথাও এত নোংরা বাস টার্মিনাল দেখিনি। বিশ্রামের কোনো জায়গা নেই, খাবার নেই, গোসল তো দূরের কথা। এ অবস্থায় অনেক যাত্রী আসতেই চায় না।
জনি নামে এক বাস হেলপার বলেন, ‘দেশের অনেক টার্মিনালে খাওয়ার ভালো ব্যবস্থা আছে, কিন্তু এখানে আসলে মনে হয় আবর্জনার মধ্যে ঢুকলাম। বিগত সরকার অনেক কিছু উন্নয়ন করেছে, কিন্তু টার্মিনালের খবর কেউ নেয়নি।'
ফারজানা আক্তার নামে এক যাত্রী বলেন, বাস থেকে নেমে ছোট বাচ্চা নিয়ে কোথায় দাঁড়াবো বুঝি না। শৌচাগার নেই, রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কোনো খাবার দোকান নেই। একমাত্র টার্মিনাল এমন হলে কোথায় যাব?
রহিমা বেগম আরেক নারী বলেন, আমি প্রায়ই মাদারগঞ্জ যাই চিকিৎসার জন্য। কিন্তু টার্মিনালে বসার জায়গা নেই, ছাউনিও নেই। রোদ-বৃষ্টি সব সহ্য করে গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। একটা টয়লেট পর্যন্ত নেই নারীদের জন্য, খুবই কষ্ট হয়। এমন অবস্থা যেন আমরা মানুষ না।
আরও পড়ুন: জামালপুরে অবৈধ ২ ইটভাটা বন্ধ করে ৩ লাখ টাকা জরিমানা
রাসেল হোসেন নামে এক কলেজছাত্র বলেন, সকালবেলা পরীক্ষার জন্য ঢাকা যাচ্ছি, কিন্তু এখানে নেমে দেখি চারদিকে কাদা আর দুর্গন্ধ। জুতা-প্যান্ট সব নোংরা হয়ে গেলো। শহরের একমাত্র বাস টার্মিনাল যদি এমন হয়, তাহলে বাইরের মানুষ কী ভাববে জামালপুর সম্পর্কে?
জামালপুর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সরকার আব্দুল্লাহ আল মামুন বাবু বলেন, দীর্ঘদিন উন্নয়ন না হওয়ায় টার্মিনালটির বেহাল দশা হয়েছে। আমরা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৮০ লাখ টাকার প্রকল্প দিয়েছি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তারা এটি বড় প্রকল্প হিসেবে গণ্য করে প্রধান প্রকৌশলীর দফতরে পাঠিয়েছে। অনুমোদন পেলে টেন্ডার আহ্বান করে দ্রুত কাজ শুরু করব।
তবে সাধারণ মানুষ বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে ‘প্রকল্প আসছে’ শুনলেও দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন হয়নি।
জামালপুরে দীর্ঘদিন ধরে বাস চালিয়ে আসা প্রবীণ চালক জহিরুল হক বলেন, টার্মিনাল উন্নয়ন না হলে পুরো জেলা শহরের পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। এখান থেকে প্রতিদিন ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, বগুড়া, পাবনা, বেনাপোলসহ বহু রুটে বাস চলাচল করে। অথচ যাত্রীসেবা বলতে কিছুই নেই।
আরও পড়ুন: অসময়ে যমুনার ভাঙনে দিশেহারা জামালপুরের মানুষ
পরিবহন বিশেষজ্ঞ মো. হান্নান মিয়া বলেন, একটি শহরের টার্মিনাল শুধু যান চলাচলের স্থান নয়, এটি শহরের পরিবহণ ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু। এখানে শৌচাগার, বিশ্রামাগার, খাবারের দোকান ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকা উচিত। দীর্ঘদিন এভাবে অবহেলায় পড়ে থাকলে ভবিষ্যতে এটি আর ব্যবহার উপযোগী থাকবে না।
স্থানীয় নাগরিক সমাজ ও পরিবহন সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোও দ্রুত টার্মিনাল উন্নয়নের দাবি জানিয়েছে। তাদের মতে, অন্তত একটি আধুনিক ছাউনিযুক্ত যাত্রী প্রতীক্ষালয়, স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার, নিরাপদ পানি ও খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা, সিসিটিভি ক্যামেরা ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা গার্ড থাকা আবশ্যক।