দুর্গাপূজা: মেধস মুনির আশ্রম থেকে এক মহাজাগতিক উৎসব

১ দিন আগে
দুর্গাপূজা, শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়; এটি বাঙালি সংস্কৃতির এক প্রাণবন্ত উৎসব, যা শরৎকালের স্নিগ্ধতা, কাশফুলের শুভ্রতা এবং ঢাকের গুরুগম্ভীর শব্দের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যায়। এটি আবেগ, ভক্তি ও ঐক্যের এক অনন্য প্রতিচ্ছবি, যা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি বাঙালিকে এক সুতোয় গেঁথে রাখে। এই উৎসবের শিকড় প্রোথিত আছে পৌরাণিক ইতিহাসে, যা আজও আমাদের সমাজে গভীর তাৎপর্য বহন করে।

শারদীয়া দুর্গাপূজার সঙ্গে জড়িয়ে আছে রামায়ণের কাহিনি। লঙ্কেশ্বর রাবণকে বধ করার জন্য সমুদ্রতটে দেবীর উপাসনা শুরু করেন রামচন্দ্র। তার উপাসনায় ১০৮টি নীল পদ্মের মধ্যে একটি পদ্ম কম পড়লে নিজের চোখের নীলবর্ণ মণিকে দেবীর পায়ে সমর্পণ করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দেখা যায়, দেবী নিজেই নীল পদ্ম লুকিয়ে রেখে ভক্তির পরীক্ষা নিচ্ছিলেন। রামচন্দ্রের তপস্যায় প্রসন্ন হয়ে দেবী তাকে রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের বর দান করেন। শরৎকালে তিনি দুর্গাপূজা করেছিলেন, সেটা ছিল অকালে। কারণ দুর্গাপূজার নিয়ম ছিল বসন্তে। দুর্গার নাম তাই বাসন্তী। অকালে দুর্গাপূজা থেকেই এর নাম হয় অকালবোধন। তবে একে ঘিরে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মিথ আছে, যেটি সত্যযুগের মেধস মুনির দুর্গাপূজাকে ঘিরেও প্রচলিত। বলা হয় রামচন্দ্রের বহু আগেই মেধস মুনির আশ্রমে দুর্গা পূজিতা হয়েছিলেন। 
কিন্তু দুর্গাপূজার উৎপত্তিস্থল সেই মেধস মুনির আশ্রম কোথায়? ঐতিহাসিক কোনো তথ্য এই আশ্রম প্রসঙ্গে নেই। আসলে ইতিহাস ও মিথের গতিপ্রকৃতি একটু ভিন্ন। ইতিহাসপূর্ব ঘটনার প্রতীকী উপস্থাপনা হলো মিথ, কিন্তু আধুনিক সময়েও মিথ তৈরি হয় নানাভাবে। যেমন ১৩৩ বছর আগে বেদানন্দ স্বামী দৈবক্ষমতা দিয়ে জেনেছিলেন, সেই মেধস মুনির আশ্রম চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর করলডেঙ্গার পাহাড়ে। বেদানন্দ স্বামীর উদ্যোগেই গড়ে ওঠে এই আশ্রম।


দুর্গাপূজার পৌরাণিক ইতিহাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার করলডেঙ্গা পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত মেধস মুনির পবিত্র আশ্রম। শ্রীচণ্ডী অনুসারে, জীবনের কঠিন সংকটের সময়ে রাজা সুরথ এবং বৈশ্য সমাধি আশ্রয় নিয়েছিলেন এই মেধস মুনির কাছে। মুনি তাদের জাগতিক আসক্তির কারণ ব্যাখ্যা করে দেবী মহামায়ার আরাধনার নির্দেশ দেন। এই নির্দেশনা অনুসারে, তারা নদীর তীরে মাটি দিয়ে প্রতিমা নির্মাণ করে দেবী দুর্গার পূজা শুরু করেন। তাদের ভক্তি ও নিষ্ঠায় দেবী আবির্ভূত হন, আর এভাবেই সূচনা হয় এই মহিমান্বিত পূজার ঐতিহ্য। এটিই দুর্গাপূজার প্রথম সূচনা, যা পরবর্তীতে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।


সমুদ্র ও নদীবিধৌত সুশান্ত বন-বনানীতে সুবেষ্টিত চট্টগ্রাম; অতি পবিত্র স্থান। বিষ্ণুক্রান্তার অন্তর্গত চট্টলার ভূমি স্বর্গেও বিরল। শাস্ত্রে আছে- 'বিন্ধ্যপর্বতমারভ্য যাবচ্চট্টল দেশতঃ। বিষ্ণু ক্রান্তেতি বিথ্যঅতা সা ভূমিঃ স্বর্গদুর্ল্লভা।' অর্থাৎ- বিন্ধ্যাপর্বত এর নিকটে বিখ্যাত ভূমি স্বর্গেও দুর্লভ। আর এ সুদুর্লভ ভূমিই হলো চট্টগ্রাম। চট্টলকবি বসন্ত কুমার তার 'চট্টল প্রশস্তি গীতায়' চট্টগ্রামের প্রশস্তি করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন-
‘মৃত্তিকা যাঁর ধন্য হইল
মার্কণ্ডেয় মুনিচরণ ছুমে।
স্বামী বেদানন্দ লীলা পরিহরি,
সমাধি নিলেন যাঁহার ভূমে।
যেথা চণ্ডী- বক্তার কীর্তি স্বরূপ,
মেধসাশ্রম তীর্থ স্থান।
পুণ্যের খনি প্রজ্ঞার ভূমি
গাও চট্টলার বিজয় গান।’


পৌরাণিক গ্রন্থ মতে, সবুজ-শ্যামল তরুলতা শোভিত এই মেধসাশ্রম। পাহাড়স্তরের নিম্নভাগে চম্পকারণ্য। চম্পকারণ্যের উভয় পার্শ্বে পাহাড়ের বাহুর ওপর দিয়ে আশ্রমে ওঠার পথ। বামবাহুর বামভাগে নাভিগঙ্গা। ওই নাভিগঙ্গাসদৃশ গভীর কুন্ডাকারে বিরাজমান। সেই কুন্ডের মধ্যে পাহাড়ের নির্ঝারিণীর নির্ঝর নিকর সুমধুর ধ্বনিতে অবিরাম ধারায় প্রবাহিত জল অতি সুমধুর। পর্বতবাসীরা দেবতাবোধে ওই কুন্ড পূজা করে। এর ওপর বিষ্ণুপদ লাঞ্চিত শঙ্খ-চক্র চিহ্নিত অনেক কুন্ড রয়েছে। নাভিগঙ্গার নিম্নদেশে ত্রিশূল চিহ্নিত ব্যাসকুন্ড।

 আশ্রমের দক্ষিণাংশে নানাবিধ সুরভি কুসুম ভূষিত সুরথকুন্ড ও বৈশ্যকুন্ড বিরাজমান। আশ্রম সম্মুখে একটি প্রাচীন বিল্বতরু ও চারপাশে আমলকী কানন। আশ্রমের পূর্বাংশে চতূর্ধন পরিমিত মার্কন্ডেয় কুন্ড। পাহাড়ি ঝরণা দুইভাগ হয়ে এক ধারায় নাভিগঙ্গায় ও অপর ধারা মার্কন্ডেয় কুন্ডে প্রবাহিত হয়েছে। মার্কন্ডেয় কুন্ডে কচ্ছপাকৃতি পাষাণখন্ড বিরাজিত। কুন্ডের ওপর মার্কন্ডেয় ঋষির পদচিহ্ন রয়েছে। এর ওপর মার্কন্ডেয় আশ্রম ও দশমহাবিদ্যার স্থান স্তরে স্তরে বিরাজমান। উভয় আশ্রমের দৃশ্য অতিমনোরম। আশ্রমে প্রবেশ করলেই চিত্তপ্রসাদ উদ্ভব হয়। এই শোভা বর্ণানাতীত।


আশ্রমের প্রধান ফটক দিয়ে প্রায় আধা কিলোমিটার যাবার পরে ওপরে ওঠার সিঁড়ি। প্রায় ১৪০টি সিঁড়ি ভেঙে উঠলে মেধস মুনির মন্দির চোখে পড়বে। এই মন্দিরের পরই দেবী চন্ডীর মূল মন্দির। আশ্রমের ভেতরে বেশ কয়েকটি মন্দির রয়েছে, যেমন - গণেশ মন্দির, মেধস মুনির মন্দির, কামাখ্যা মন্দির, শিবমন্দির এবং তারা কালী মন্দির। এছাড়াও, আশ্রমের কাছে একটি মানস সরোবর রয়েছে, যা ঝরনা দ্বারা পূর্ণ হয়। জনশ্রুতি আছে যে, ত্রেতাযুগে সীতা দেবী এই পবিত্র স্থানে স্নান করেছিলেন। স্থানীয়দের ভাষ্য, আশ্রমের এ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে পূণ্যার্থীরা একসময় মুগ্ধ হয়ে পড়তেন। চারদিকে গাছগাছালির ছায়া, সবুজ বনজঙ্গলে নানা ধরনের ফলের গাছ দেখা যেত। সেগুলোর জন্য বন্যপ্রাণীরা আশ্রমের চারপাশে আসত, কিন্তু কখনো কারো ক্ষতি করার কথা শোনা যায়নি। ইদানিং বনাঞ্চল কমে যাওয়ায় সেসব প্রাণির দেখা আর মেলে না।


ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, চট্টলে মেধসাশ্রম আবিস্কার এক দৈব ঘটনা। স্বামী বেদানন্দ মহাত্মাই ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে যোগবলে জ্ঞাত হয়েই এ পূণ্যতীর্থ উদ্ধার করেন। স্বামী বেদানন্দ আবিস্কৃত এ পবিত্র স্থানেই বহু হাজার বছর পূর্বে মহাশক্তি জগন্মাতার আগমন ঘটেছিল। এ পবিত্র স্থানই মর্ত্যলোকে মঙ্গলময়ী মায়ের আবির্ভাবের আদিস্থান। এখানেই প্রথম মৃন্ময়ী প্রতিমাতে দেবীর আরাধনা হয়েছিল। ‘কৃত্মা মূর্তিং মহীময়ীম্ৎ’ (চণ্ডী-১৩/১২)। মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তিতে পূজা হয়েছিল প্রথম এ বাংলায়- এ চট্টগ্রামে। এ কথা শ্রীচণ্ডীতে সুস্পষ্ট। কল্পান্তরে স্বারোচিষ মন্মন্তরে মর্ত্যে প্রথম দুর্গাপূজা করেন রাজা সুরথ আর সমাধি বৈশ্য বেদজ্ঞান সম্পন্ন মুনিবর মেধসের নির্দেশে মৃন্ময়ী প্রতিমাতে চট্টগ্রামের পুণ্যক্ষেত্র চণ্ডীতীর্থ মেধসাশ্রমে।


শারদীয় দুর্গাপূজা শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়; এটি ভারতীয় উপমহাদেশের এক বিশাল সাংস্কৃতিক আয়োজন। এটি কেবল বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর আকর্ষণ ভারত ও বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামসহ প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই বাঙালিরা এ শারদীয় দুর্গোৎসবে মেতে ওঠে। এই সময়ে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সবখানেই এক উৎসবের আমেজ দেখা যায়। দুর্গাপূজা উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গান, নাচ, নাটক, যাত্রাপালাসহ নানা ধরনের লোকনৃত্য পরিবেশিত হয়। এটি নতুন প্রজন্মকে নিজেদের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।
২০১৬ সালে ইউনেস্কো কলকাতার দুর্গাপূজাকে বিশ্বের অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই স্বীকৃতি প্রমাণ করে যে, দুর্গাপূজা কেবল একটি ধর্মীয় আচার নয়, এটি এক বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক উৎসব। এটি শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসকে ধারণ করে না, বরং সামাজিক সম্প্রীতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং শিল্প-সংস্কৃতির এক বিশাল মিলনক্ষেত্র হিসেবেও কাজ করে।


১. সামাজিক সম্প্রীতি ও ঐক্য: দুর্গাপূজা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল প্রতীক। প্রতিমা দর্শন, শুভেচ্ছা বিনিময় এবং উৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করার মাধ্যমে এই উৎসব কেবল ধর্মীয় আচারেই সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং এটি সমাজে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা ও ঐক্যের বন্ধনকে দৃঢ় করে তোলে।


২. সাংস্কৃতিক নবজাগরণ: দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যেমন—নৃত্য, গান, নাটক, লোকনৃত্য ও যাত্রাপালার আয়োজন করা হয়। এর মধ্য দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতি নতুন রূপে উদ্ভাসিত হয়। এই উৎসব তরুণ প্রজন্মকে নিজেদের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত করে এবং শেকড়ের প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তোলে। 


৩. অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান: দুর্গাপূজা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্যও এক গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার প্রতিমাশিল্পী, মণ্ডপশিল্পী, কারিগর, আলোকসজ্জাকারী, এবং ঢাকী কাজের সুযোগ পান। পূজার সময় বাজারে পোশাক, অলংকার, প্রসাধনী, মিষ্টি ও খাদ্যপণ্যের বিক্রি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। কিছু প্রতিবেদন অনুসারে, এই উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক লেনদেন হয়, যা দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।


মেধস মুনির আশ্রম থেকে শুরু হওয়া দুর্গাপূজা আজ বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং আধ্যাত্মিক এক মহোৎসবে রূপ নিয়েছে। দেবী দুর্গার আগমন আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে অন্যায় ও বিভাজনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে শেখায়। আর তার বিদায় আমাদের নতুন শক্তি ও আশার আলো নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দেয়। দুর্গাপূজা তাই কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বাঙালির এক নতুন করে জেগে ওঠার উৎসব, যা আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি ভালোবাসাকে আরও গভীর করে।

 

তথ্যসূত্র:
১. Bangladesh Puja Udjapan Parishad (2023)
২. Prothom Alo (2023)
৩. Desh Rupantor (2019)
৪. The Daily Star (2015)
৫. Wikipedia (n.d.)
৬. Samakal.com, 'মেধস মুনির আশ্রম'
৭. Prothomalo.com, 'পাহাড়চূড়ায় মেধস মুনির আশ্রম'
৮. Daily Janakantha, 'দুর্গাপূজার অর্থনীতি'

 

লেখক: প্রবীর চন্দ্র দাস
সিনিয়র সহকারী পরিচালক
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)
 

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন