দালালের খপ্পরে পড়ে জাহাঙ্গীর হারিয়েছেন জীবনের ১৮টি বছর

২ দিন আগে
দালালের খপ্পরে পড়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার পর দীর্ঘ ১৮ বছর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার অবসান ঘটিয়ে নরসিংদীর চরদিঘলদী ইউনিয়নের জিতরামপুর গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম ফিরে এসেছেন নিজের ঘরে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহায়তায় তার পরিচয় নিশ্চিত করে দেশে ফেরাতে উদ্যোগ নেয় সংশ্লিষ্ট দফতর।

নরসিংদী সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসমা জাহান সরকার শুক্রবার (১৪ নভেম্বর) বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

 

ভুক্তভোগী জাহাঙ্গীর আলম (৬৬) চরদিঘলদী ইউনিয়নের মৃত গিয়াস উদ্দিনের ছেলে। পরিবারে স্ত্রী ও পাঁচ সন্তান নিয়ে কষ্টে দিন চলত তার। পেশায় ছিলেন জেলে। লোভী দালালের প্রলোভনে পড়ে আর্থিক স্বচ্ছতার আশায় বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান তিনি। এরপরই শুরু হয় তার জীবনের দুঃখ-কষ্টে ভরা অধ্যায়।

 

বৃহস্পতিবার বিকালে অনুদান গ্রহণের সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। ওই কার্যালয় থেকে রাতে ফেসবুকে দেয়া এক স্ট্যাটাসে বলা হয় পরিবার যার মৃত্যুর শঙ্কায় বহুদিন আগে কান্না থামিয়ে দিয়েছিল, তিনি ফিরে এসেছেন পরিবারের সামনে অসুস্থ, বাকশক্তিহীন, কিন্তু জীবিত।

 

জাহাঙ্গীর আলমের জন্ম দরিদ্র পরিবারে। বিশাল মেঘনার বুকে মাছ ধরে জীবিকা চলত তার। চার ছেলের জন্মের পর যখন পঞ্চম সন্তানের গর্ভে ছিলেন স্ত্রী, তখনই ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় দালালের মাধ্যমে অবৈধ পথে মালয়েশিয়ায় যান তিনি। প্রথমদিকে যোগাযোগ থাকলেও ধীরে ধীরে তা বন্ধ হয়ে যায়। সময়ের সাথে পরিবার ধরে নেয় তিনি আর বেঁচে নেই। শুরু হয় দেড় যুগের অন্তহীন অন্ধকার।

 

নরসিংদী সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার সূত্রে জানা যায়, গত ২১ অক্টোবর মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাই কমিশন থেকে কাউন্সেলর (লেবার) সৈয়দ শরীফুল ইসলাম ফোন করে জানান এক বাংলাদেশি আটক রয়েছেন ক্যাম্পে, যার কাছে কোনো পাসপোর্ট, আইডি কার্ড বা অন্য কোনো কাগজপত্র নেই। অসুস্থতার কারণে কথা বলতে পারেন না নাম-পরিচয় কিছুই জানা যাচ্ছিল না।

 

হাই কমিশন ব্যক্তির ছবি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেকে তাকে স্বজন দাবি করলেও কেউই যথাযথ প্রমাণ দেখাতে পারেননি। এ সময় নরসিংদী সদরের এক ব্যক্তি পোস্টে মন্তব্য করে জানান লোকটি চরদিঘলদী ইউনিয়নের বাসিন্দা হতে পারেন। হাই কমিশনের অনুরোধে ইউএনও দ্রুত মাঠে নামেন এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় খুঁজে পাওয়া যায় জাহাঙ্গীর আলমের পরিবারকে। কথা বলে নিশ্চিত হওয়া যায় আটক ব্যক্তিই ১৮ বছর আগে নিখোঁজ হওয়া জাহাঙ্গীর আলম।

 

আরও পড়ুন: কুয়েতে চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ২২ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ

 

পরিবারের করুণ আর্থিক অবস্থা উপলব্ধি করে প্রয়োজনীয় সব নথি দ্রুত হাই কমিশনে পাঠান ইউএনও। পাশাপাশি সরকারি ব্যয়ে তাকে দেশে পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়। গত ৭ নভেম্বর দেশে ফিরেন জাহাঙ্গীর আলম। পরিবার তাকে বিমানবন্দর থেকে বাড়ি নিয়ে আসে। কিন্তু ফিরেও যেন তিনি পুরোপুরি ফিরে আসতে পারেননি।

 

মালয়েশিয়ায় অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে দীর্ঘদিন আটক জীবন তাকে শারীরিকভাবে ভেঙে দিয়েছে। গুরুতর অসুস্থ তিনি; হারিয়েছেন বাকশক্তি, বাংলাও স্পষ্ট বলতে পারেন না। কখনও নির্বাক, কখনও আবার টানা কান্নায় ভেঙে পড়েন। এই দেড় যুগেই হারিয়েছেন বাবা-মাকে। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে তার স্ত্রীও অন্যের সংসার গড়েছেন।

 

গত বৃহস্পতিবার বিকালে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে ২০ হাজার টাকা নগদ সহায়তা ও প্রয়োজনীয় উপহার সামগ্রী দেয়া হয়। উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের মাধ্যমে তার নামে প্রতিবন্ধী ভাতা অনুমোদনের প্রক্রিয়া চলছে। বর্তমানে তিনি নরসিংদী জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

 

জাহাঙ্গীর আলমের বড় ছেলে আমান উল্লাহ বলেন, ‘আমরা বাবাকে ফিরে পেয়েছি এটাই আমাদের জন্য বড় পাওয়া। পরিবারে এখন আনন্দের বন্যা।’

 

চরদিঘলদী ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোসা. সেলিনা আক্তার বলেন, ‘আমাদের পরিষদ থেকে তাকে ৫ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। নরসিংদী জেলা হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে। মানবিক কারণে আমরা তার পাশে আছি। দীর্ঘ বছর পর তিনি ফিরে এসেছেন আমরা আনন্দিত। দালালের প্রলোভনে যেন আর কেউ দেশের বাইরে না যায়, সে বিষয়ে আমরা সবাইকে সচেতন করার চেষ্টা করছি।’

 

নরসিংদী সদর উপজেলার ইউএনও আসমা জাহান সরকার বলেন, ‘জ্ঞাত–অজ্ঞাতসারে কেউই যেন জাহাঙ্গীর আলম বা তার পরিবারের মতো ভুলের পুনরাবৃত্তি না করেন। দালালের খপ্পরে পড়ে অবৈধ পথে বিদেশ গমনের চেষ্টা করবেন না। একটি ভুল যেন আরেকটি পরিবারের সারা জীবনের কান্না হয়ে না দাঁড়ায়।’

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন