এক বুক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শেফালি বেগম বলেন, ‘এখনতো নদী বলতে কিছুই নেই। আমাদের দিন আর ভালো চলে না। এখানে বড় একটি ঘাট ছিল, সেখানে পণ্যবাহী ট্রলার ভিড়তো। কত লোকের ভিড় হতো, এখন সব শূন্য।’
শুধু শোলমারি নদী নয় খুলনা অঞ্চলের ২২টি নদী বর্তমানে চরম সংকটে রয়েছে। দখল, দূষণ, পলি ভরাটের কারণে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে নদীগুলোর। আর এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে নদীকেন্দ্রিক জনজীবন ও অর্থনীতিতে।
এক সময় যেসব নদীপথ ছিল পণ্য পরিবহনের মূল রুট, সেগুলোর অধিকাংশই এখন মৃতপ্রায়। ফলে এই অঞ্চলের নৌবন্দরগুলো প্রায় অচল হয়ে পড়েছে, মুখ থুবড়ে পড়েছে নদীনির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্য।
অস্তিত্ব হারাচ্ছে ২২ নদী
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) তথ্য অনুযায়ী, খুলনা বিভাগের অন্তত ২২টি নদী বর্তমানে চরম সংকটে। এর মধ্যে খুলনার ময়ূর, ভৈরব, হামকুড়া, কাজীবাছা, যশোরের টেকা, কুমার, হরিহর, শোলমারি, ঝিনাইদহের বেতনা, কুষ্টিয়ার কালিগঙ্গা এবং সাতক্ষীরার ইছামতী নদীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অস্তিত হারাতে বসা এসব নদীর ১৫টি বাণিজ্যিক নৌরুটও বন্ধ হয়ে গেছে।
আরও পড়ুন: গড়াইয়ে ড্রেজার ও এস্কেভেটর দিয়ে বালু তোলার মহোৎসব!
বটিয়াঘাটার স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, শোলমারি নদী দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে নৌযানে করে পাট, সার, সবজিসহ বিভিন্ন পণ্য পরিবহন হতো। নদী থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন স্থানীয়রা। পানি দিয়ে কৃষি কাজও চলতো। তবে চর পড়ে এখন সেই নদী মৃতপ্রায়।
স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ী আব্দুল খালেক বলেন, এই নদী আমাদের পেট চালাতো। এখন পানি নাই, মাছও নাই। মাছ ধইরা যা পেতাম, তা দিয়াই সংসার চলতো। এখন তা আর হয় না। এই তো সেদিনও এই নদী থেকে কত বড় বড় জাহাজ পণ্য নিয়ে যেতো, এখনতো নৌকাও চলে না।

নদীর পানি কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন স্থানীয় চাষীরাও। নদীর পানি ব্যবহার করতে না পারায় সেচকাজের জন্য বড় অংকের টাকা গুনতে হচ্ছে তাদের। স্থানীয় শফিকুল মোল্লা বলেন, বর্ষা মৌসুম ছাড়া আমাদের ক্ষেতে প্রায় ৮ মাসই খরা থাকে। এতে ফসল উৎপাদনের খরচও বেড়ে যায়।
জমজমাট নদীবন্দরে এখন নেই ব্যস্ততা
খুলনা বিভাগের অন্যতম প্রধান নদীবন্দর নওয়াপাড়া। এক সময় যেখানে প্রতিদিন গড়ে ১৫০টির বেশি পণ্যবাহী জাহাজ ভিড়তো, এখন সেই সংখ্যা নেমে এসেছে অনেক নিচে। পণ্য পরিবহনের জন্য ব্যবসায়ীদের এখন নির্ভর করতে হচ্ছে সড়কপথে, যেখানে খরচ তিনগুনেরও বেশি।
আরও পড়ুন: অসময়ে মধুমতিতে ভাঙন, ভিটেমাটি হারানোর শঙ্কায় নদী পাড়ের বাসিন্দারা
২০১৮ সালে যেখানে এ অঞ্চলে নৌপথে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার পণ্য পরিবহন হতো, সেটি বর্তমানে নেমে এসেছে ৩০০ কোটি টাকায়। নাব্য সংকটে ছোট নদীতে ভারী জাহাজ চলাচলে বাড়ছে দুর্ঘটনা। গত বছর এক মাসেই ভৈরব নদীর খুলনা-নওয়াপাড়া অংশে তিনটি জাহাজ ডুবির ঘটনা ঘটেছে। নদীতে পলি জমে পানির গভীরতা কমে যাওয়ায় জাহাজ কাত হয়ে তলিয়ে যাচ্ছে।
একাধিক নৌযান মাস্টার ও ঘাট ইজারাদার জানান, জাহাজ নিয়ে ১০-১৫ দিন ধরে নদীতে অপেক্ষা করতে হয়। এতে ক্ষতির মুখে পড়ছি আমরা, বন্দরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
খুলনা বিভাগীয় অভ্যন্তরীণ মালিক গ্রুপের সদস্য মো. হাফিজুল ইসলাম বলেন, নদীগুলোর এমন দশা আমরা কল্পনাও করিনি। এখন খুলনা ও নওয়াপাড়া বন্দরে পণ্যবাহী জাহাজ অর্ধেকে নেমে এসেছে। আমাদের বাধ্য হয়ে মোংলা থেকে সড়ক পথে পণ্য আনতে হচ্ছে। সড়ক পথে পণ্য পরিবহনে খরচ হয় তিনগুনেরও বেশি। ফলে পণ্যের দামের ওপর এর প্রভাব পড়ে।
কেন মরছে নদী, সমাধান কী
খুলনা নদী বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র খুলনা জেলায় নদীর পাড়ে ৬৪টি অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, নদী পাড়ে গড়ে উঠেছে অর্ধশত ইটভাটা। এছাড়া অপরিকল্পিত বাঁধ, স্লুইসগেট ও সেতু নির্মাণে নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। এতে করে নদীর পানি দিয়ে দেয়া যাচ্ছে না সেচ, কৃষিতে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা ও মাছের উৎপাদনও কমে গেছে।

পানি সম্পদ বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাতের মতে, নদী মরছে না, নদীকে আমরা গলাটিপে হত্যা করেছি। স্থানীয় প্রভাবশালীরা নদীর পাড় দখল করে অবৈধ স্থাপনা করছে, অথচ সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা সরকার কিছুই ভাবছে না। আমি মনে করি সরকার নীতিগতভাবে ভুল করছে। সরকার সড়ক পথকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। অথচ সরকার যদি নৌরুট নিয়ে ভাবতো, সেটা আরও অনেক বেশি ভালো হতো।
আরও পড়ুন: কুড়িগ্রাম / ৩০৮ কিলোমিটার অরক্ষিত নদী পাড়, আতঙ্কে গ্রামবাসী
তবে এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, শুধু ড্রেজিং নয়, নদী ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। উজান থেকে পানিপ্রবাহ নিশ্চিত না করলে খননেরও ফল হবে না। এটা সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া সম্ভব নয়।
বিআইডব্লিউটিএ খুলনার উপপরিচালক মো. মাসুদ পারভেজ জানান, ‘নদীবন্দরগুলোর উন্নয়ন এবং মৃতপ্রায় নদীগুলো বাঁচাতে আমরা বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছি। কিছু কিছু এলাকায় কাজ শুরু হয়েছে। বাকিগুলো বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় আছে।’
খুলনা ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ শতাব্দী ধরে নদীর ওপর নির্ভর করে জীবিকা গড়েছেন। কিন্তু সেই নদীগুলো আজ মানুষের জীবন থেকে, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। সরকারি উদ্যোগ বাস্তবায়ন না হলে অচিরেই এই অঞ্চলের নদীকেন্দ্রিক অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙে পড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
]]>