তিস্তায় পাথর সিন্ডিকেটের ভয়ংকর থাবা, মানবিক বিপর্যয় ঠেকাবে কে?

১ দিন আগে
নীলফামারীর ডিমলায় তিস্তা নদী থেকে অবৈধভাবে পাথর ও বালু উত্তোলন বেড়েছে। এই পাথর সিন্ডিকেটের কারণে ডিমলার নদী ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। ইতোমধ্যে খগাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের কিসামত চর, ভাষানীর চর গ্রাম, নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এতে আশপাশের গ্রাম ও মানুষের জীবিকা ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে উত্তরবঙ্গের প্রাণখ্যাত তিস্তা নদী শুধু একটি ভৌগোলিক সংকটই নয়, বরং মানবিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।

সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উজানে নির্বিচারে পাথর উত্তোলনের ফলে নদীর মাঝখানে জমে ওঠে বিশাল বালুর চর। ইঞ্জিনচালিত নৌকা দিয়ে নদীর তলদেশে গভীর খনন করে সেখান থেকে পাথর উত্তোলন করে জালের মতো ছাঁকনি দিয়ে আলাদা করে নৌকায় রাখা হয়। পাথরভর্তি নৌকাগুলো নদীর পাড় থেকে ট্রাকে করে শঠিবাড়ী বাজার, ডালিয়া বাজার সড়কের ধারে স্তূপ করে রাখা হয়। সেখান থেকে রাতারাতি পাথর বিক্রি করা হয়। অবৈধভাবে পাথর ও বালু উত্তোলন করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সিন্ডিকেট চক্র।


শুধু নদী নয়, তিস্তার ডান তীর বাঁধঘেঁষে সরকারি খাস জমি দখল করে একই পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন চলছে বছরের পর বছর। কেউ কেউ আবার নিজেদের মালিকানাধীন জমিতে গড়ে তুলেছে ক্ষুদ্র পাথর কারখানা। এর ফলে নদী ভাঙন, পথঘাট ভাঙন এবং জমির মাটি দেবে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। অনেকে মন্তব্য করে বলেছেন, সিলেটের সাদা পাথরের ন্যায় তিস্তার পাথরও লুট করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে খগাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের কিসামত ও ভাষানীর চর বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়াও তিস্তা ব্যারেজের ভাটি এলাকা হুমকির মুখে পড়েছে।


প্রতিনিয়ত নদীর ডান তীরে সরে আসছে। তিস্তা নদীতে বড় ধরনের বন্যা আসলে নদী আসল রূপ ধারণ করে শত শত এলাকা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।


আরও পড়ুন: নদীগর্ভে বিলীন তিস্তা সেতু রক্ষার ১০০ মিটার বাঁধ, হুমকিতে তিন গ্রাম


জানা যায়, ভারতের উজান থেকে নেমে আসা তিস্তা নদীর পানি বহুকাল ধরেই উত্তরবঙ্গের জীবন ও জীবিকার অন্যতম উৎস। এই নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে ফসলি জমি, বসতবাড়ি ও দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজ। কিন্তু বর্তমানে নদীটি এক ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি। ডিমলা উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় দিন-রাত চলছে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের মহোৎসব। প্রভাবশালী চক্রের মদদে শত শত ইঞ্জিনচালিত নৌকা ব্যবহার করে নদী থেকে অবাধে তুলে নেয়া হচ্ছে হাজার হাজার ঘনফুট পাথর। কয়েক বছর ধরে চলা এই কর্মকাণ্ডে নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, নদীর তীর ভেঙে যাচ্ছে, এবং ভিটেমাটি হারাচ্ছেন হাজারো পরিবার।


প্রতিদিন উপজেলার বাইশপুকুর, চরখড়িবাড়ি, একতা বাজার, তেলির বাজার, তিস্তা বাজার, কালীগঞ্জ ও ছোটোখাতা গ্রোয়েন বাঁধসহ অন্তত ১৫-২০টি স্থানে প্রশাসনের নীরবতার সুযোগে প্রভাবশালী চক্রের মদদে অব্যাহত রয়েছে এ ধ্বংসযজ্ঞ।


মাছের ব্যাপক হ্রাস, প্রজননস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং তলদেশের নাজুক স্তর নষ্ট হওয়ার কারণে নদীর জৈবিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে। যা তিস্তা ব্যারেজের অদূরে, তিস্তা বাজার, তেলির বাজার, চরখড়িবাড়ি, বাইশপুকুর, কালীগঞ্জ, ভেন্ডাবাড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় পাথর উত্তোলনে প্রায় ১৫টি প্রভাবশালী চক্র জড়িত রয়েছে। পাথর উত্তোলনে শতশত ইঞ্জিনচালিত নৌকা ব্যবহার করা হচ্ছে। নৌকা চলন্ত অবস্থায় শ্যালো ইঞ্জিনচালিত পাখা দিয়ে নদীর তলদেশের বালু সরিয়ে পাথর তুলে পানির ওপরে নিয়ে আসা হয়। এভাবেই নদীর বিভিন্ন স্থানে সক্রিয় টিম পাথর উত্তোলন করছে।


আরও পড়ুন: তিস্তায় সেতু রক্ষা বাঁধে ধস, ভাঙন আতঙ্কে ১২শ’ পরিবার


 

তিস্তার ডান তীর বাঁধঘেঁষে সরকারি খাস জমি দখল করে পাথর উত্তোলন চলছে। ছবি: সময় সংবাদ


এলাকাবাসীর অভিযোগ, অতীতে আওয়ামী লীগের নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে গড়ে তোলা টিম পাথর উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত ছিল। দেশের প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর সেই দলটি ক্ষমতা হারালেও, বর্তমানে নতুন রূপে আবারও আরেকটি দল সক্রিয় হয়েছে। শত শত ট্রলি দিয়ে নদীর পাড় থেকে পাথর পরিবহনের ফলে তিস্তার ডান তীর প্রধান বাঁধ ও গ্রামীণ রাস্তাঘাট মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।


এরই মধ্যে ছোটোখাতা তফেল মেম্বারপাড়া, বাইশপুকুর, সীমান্তবর্তী কালীগঞ্জ, বার্ণিরঘাট বিজিবি ক্যাম্প এলাকার গ্রামগুলো ভাঙনের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।


এলাকাবাসীর দাবি, ২০১৬ সালের আগেই প্রভাবশালী একটি চক্র উপজেলাজুড়ে তিস্তা নদী, সরকারি খাসজমি ও নিজস্ব জমি থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন শুরু করে। সেই থেকে প্রতিবছরই নদী ভাঙনের কবলে পড়ে কয়েক হাজার মানুষ বারবার বাস্তুহারা হয়েছেন।


আরও পড়ুন: কমছে তিস্তার পানি, তবুও কাটেনি বন্যার শঙ্কা


কেউ আশ্রয় নিয়েছেন আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে, কেউবা বাঁধের ধারে অস্থায়ী ছাউনি গেড়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এ ছাড়া নদীর পাড় থেকে বিভিন্ন স্থানে পাথর পরিবহনের সময় ট্রাক্টর ও ট্রলির পানি ঝরে পড়ায় বন্যা নিয়ন্ত্রণের ডান তীরের প্রধান বাঁধ ও স্থানীয় সড়কগুলোর বেহাল দশা হয়েছে। অনেক সড়ক চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে চলে পাথর পরিবহনের এ কার্যক্রম।


চরখড়িবাড়ি এলাকার বাসিন্দা কৃষক হাফেজ আলী মোল্লা বলেন, ‘গত চার বছরে আমি দুবার বাড়িঘর হারিয়েছি। এক সময়ের ভাষানীর চর আজ সম্পূর্ণ বিলীন। বসতভিটা হারানোর বেদনা আমি ছাড়া আর কেউ বুঝবে না।’


ছোটোখাতা তফেল মেম্বারপাড়ার বাসিন্দা হানিফ উদ্দিন প্রামাণিক বলেন, ‘অবৈধ পাথর উত্তোলনের কারণে চর খগাখড়িবাড়ি এলাকায় বিলীন হয়েছে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একতার বাজার। এমনকি বিজিবির ক্যাম্পও ভাঙনের শিকার হয়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একইসঙ্গে ইউনিয়নের প্রায় ২০ হাজার মানুষ হয়ে পড়েছেন গৃহহারা। এ ছাড়া পাথর পরিবহনের কারণে উপজেলার কাঁচা-পাকা সব সড়কের অবস্থাই ভেঙে বেহাল, যা এখন চলাচলের প্রায় অযোগ্য।’


পাথর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করে অবৈধ উত্তোলন বন্ধের অনুরোধ জানালেও স্থানীয় অসাধু মহল তা কর্ণপাত করেনি।


আরও পড়ুন: কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি, নিম্নাঞ্চল প্লাবিত


পরিবেশবিদরা জানান, তিস্তা নদী থেকে এভাবে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন অব্যাহত থাকলে নদী তীরবর্তী জনপদের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে। কারণ, নদীর তলদেশ থেকে নির্বিচারে পাথর ও বালু তোলায় পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। এতে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করছে।


দীর্ঘমেয়াদী এ ভাঙনের ফলে হাজারো মানুষকে বারবার বাস্তুহারা হতে হবে, গ্রামীণ অবকাঠামো ধ্বংস হবে, এমনকি কৃষিজমি ও জীববৈচিত্র্য চিরতরে হারিয়ে যাবে। তাই পরিবেশবিদরা অবিলম্বে অবৈধ পাথর উত্তোলন বন্ধ করে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এবং নদী ও পরিবেশ রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।


আরও পড়ুন: টিকে থাকার লড়াইয়ে চরের ৪ লাখ পরিবার


পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী বলেন, ‘তিস্তা নদীতে পাথর বা বালুমহাল নেই। এ ছাড়া নদী থেকে পাথর বালু উত্তোলনে নিষেজ্ঞাধাও রয়েছে। নদীর বালু,পাথরের উত্তোলনের বিষয়ে দেখার দায়িত্ব প্রশাসনের।’


তিনি আরও বলেন, ‘নদীর ভাঙন রোধে বিভিন্ন অবকাঠামো রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের।’


উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইমরানুজ্জামান বলেন, ‘নদী ও পরিবেশ রক্ষায় অবৈধ পাথর উত্তোলনের বিরুদ্ধে প্রশাসন শূন্য সহনশীলতা নীতি অনুসরণ করবে।’

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন