অবশ্য পুলিশ বলছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশের সকল ইউনিট কাজ করছে। অপরাধীদের আটকের পাশাপাশি সচেতনতা তৈরিতেও কাজ করছে তারা।
গত ১২ মে যশোর শহরের ষষ্টিতলায় সন্ধ্যায় বিপুল নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা। তার পরিবারের দাবি দীর্ঘদিন ধরে হুমকি ধামকি দেয়া হচ্ছিলো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহায্য চেয়েও তারা কোনো সাহায্য পাননি। এরপর কৌশলে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয় বিপুলকে। কেবল বিপুল নন গত ২২ মে ঘের ইজারা দেয়ার নামে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয় অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া পৌর কৃষকদলের সভাপতি তরিকুল ইসলামকে। এভাবে গত তিন মাসে যশোরে জমিজমা, রাজনৈতিক ও পারিবারিক বিরোধের জেরে ১৮ জনকে হত্যা করা হয়েছে। যাদের কুপিয়ে, গুলি করে, ধর্ষণের পর হত্যার মতো হৃদয়বিদারক কায়দায় খুন করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এ অবস্থা নিয়ে জনমনে গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
সচেতন নাগরিক ও বিশেষজ্ঞদের মতে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব অবহেলা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি সর্বোপরি পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এর জন্য দায়ী।
আরও পড়ুন: গোপালগঞ্জে এনসিপির নেতাকর্মীর ওপর হামলায় পর মাদারীপুরে নিরাপত্তা জোরদার
বিপুলের বাবা আখতার আলী ও স্ত্রী সুমাইয়া জানান, ঘাতক বাপ্পী দীর্ঘদিন ধরে হুমকি ধামকি দিয়ে আসছিলো। তারা প্রাণে বাঁচতে দেবে না বলছিল। আমরা জীবনের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনীর কাছে গিয়েছি। কোনো প্রতিকার পাইনি। কৌশলে ফোন করে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যদি তাদের অভিযোগ গুরুত্ব দিতো তাহলে হয়ত এ হত্যাকাণ্ড এড়ানো যেত।
একের পর এক হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যশোর নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সমন্বয়ক শেখ মাসুদুজ্জামান মিঠু।
তিনি বলেন, ‘৫ আগস্টের পর একটি নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিলো। সাধারণ মানুষ মনে করেছিলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে, মানুষ নিরাপদে চলাফেরা করতে পারবে। কিন্তু খুন, ধর্ষণ, ছিনতাইয়ের মত অপরাধ বেড়েছে। এতে করে আমরা অনেক শঙ্কার মধ্যে জীবনযাপন করছি।’
শেখ মাসুদুজ্জামান মিঠু আরও বলেন, ‘পুলিশ একটি অকার্যকর বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। ঘটনা ঘটার পর তারা রুটিন ওয়ার্ক করছে। কিন্তু অপরাধের লাগাম টানতে গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি, প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ, চিহ্নিত অপরাধীদের গ্রেফতার, অস্ত্র উদ্ধার ও এলাকা ভিত্তিক নিয়মিত অভিযান তার কিছুই করছে না। এতে করে আমরা শঙ্কায় আছি আগামী দিনগুলোতে এ ভয়াবহতা আরও বাড়বে কীনা। আমরা চাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের দায়িত্ব পালন করে আইনের শাসন নিশ্চিত করুক।’
আরও পড়ুন: গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনী-পুলিশ-বিজিবির সঙ্গে যোগ দিলো কোস্টগার্ড
যশোর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকন বলেন, ‘যশোরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, সারা দেশেই একই অবস্থা। সরকার পরিবর্তনের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সঠিকভাবে কাজ করছে না। মাঠ পর্যায়ে পুলিশ কাজ না করায় চরমপন্থী, সন্ত্রাসীদের উত্থান হচ্ছে। অস্ত্র উদ্ধার ও তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের ধরা হচ্ছে না। এসব নানাবিধ কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিন দিন অবনতি হচ্ছে। এটা নিয়ে সরকার তথা প্রশাসনকে ভাবতে হবে, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, এটাই আমরা চাই।’
অপরাধ বিশেষজ্ঞ যশোর সরকারি এম এম কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হামিদুল হক শাহীন বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি একদিনে হয়নি। এ বিষয়টি অনেক বৃহৎ এবং এর মূল অনেক গভীরে। এটি হচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের চরম রূপ। আমরা বিচারহীনতার সংস্কৃতির মধ্যে ঢুকে পড়েছি। পাশাপাশি মানুষজন অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। তারা বিচার দেখতে না পেয়ে বিচারকে হাতে তুলে নেয়ার চেষ্টা করছে। তা ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে হত্যাকাণ্ডের বীভৎসতা ছড়িয়ে পড়ছে, যা মানুষ অবচেতন মনে অনুকরণ করছে। আমাদের মনে রাখতে হবে অবচেতন মনই প্রতিটি মানুষের ৯৩ শতাংশ মন নিয়ন্ত্রণ করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘লক্ষ্য করবেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কখনো আত্মহত্যা, ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়লে দেশের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের অপরাধ তৎপরতা বৃদ্ধি পায়।’
আরও পড়ুন: হত্যা-ডাকাতি বাড়লেও পুলিশের দাবি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে
হামিদুল হক শাহীন বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনের পরে একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। রাষ্ট্রের সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করতে পারেনি। পরিবার পরিবারের দায়িত্বটা পালন করতে পারছে না। ফলে মানুষের মনোজগৎ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার বিভৎস প্রকাশ আমরা দেখতে পাচ্ছি। এর থেকে বের হতে হলে যে অন্যায় করছে তার বিচার হতে হবে, পারিবারিক শিক্ষা ও মূল্যবোধকে জাগ্রত করতে হবে, শিক্ষক সমাজকে শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিংয়ের দায়িত্ব নিতে হবে, সমাজের সর্বস্তরে পরিপূর্ণ সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।’
তবে এ বিষয়ে যশোর জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নূর-ই-আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘প্রতিটি ঘটনায় পুলিশ তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিয়েছে। দ্রুততম সময়ে ঘটনার কারণে উদঘাটন, অপরাধীদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। হয়তো একটি ঘটনায় জড়িত সব অপরাধীকে আমরা আইনের আওতায় আনতে পারিনি; কিন্তু আমাদের সদিচ্ছার কোনো অভাব নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘পারিবারিক বিরোধ নিয়ে যেসব ঘটনা ঘটে সেগুলো প্রতিরোধে আমরা থানা, ক্যাম্প, ফাঁড়ির মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজও করছি। যাতে কেউ অপরাধ কাণ্ডে না জড়িয়ে প্রতিকারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নেয়।’
আরও পড়ুন: র্যাবের সাঈদ, মাসুদ ও আরিফকে কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, ‘পুলিশ একেবারে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত সরব রয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও দিন ও রাতে টহল চলে। সিনিয়র অফিসারদের দিয়ে যা তদারকি করা হয়। যশোর পুলিশের প্রতিটি সদস্য যে যার জায়গা থেকে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে জনগণের জান ও মালের নিরাপত্তার জন্য সর্বদা সজাগ আছে।’
প্রসঙ্গত, যশোর জেলা পুলিশ গত তিন মাসে দুই হাজার ৯২ জনকে গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে নিয়মিত মামলার আসামি ৮৭৪ জন, ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি এক হাজার ১৯২ জন, বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ অন্যান্য আইনে ২৮ জন।