তিন বছরেও চালু হয়নি ৩৯ কোটির ভবন, চিকিৎসা চলছে বারান্দায়

৩ দিন আগে
একদিকে চিকিৎসার জন্য হাহাকার, অন্যদিকে কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত আধুনিক ভবনে তালা ঝুলছে বছরের পর বছর। গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালে শয্যা সংকটে বারান্দা আর মেঝেতে রোগীদের চিকিৎসা নিতে হচ্ছে দিনের পর দিন। অথচ হাসপাতাল চত্বরে নির্মিত হয়েছে এক নয়, দুটি আধুনিক ভবন যেখানে রয়েছে ২৫০ শয্যার বিশাল সুযোগ-সুবিধা, আধুনিক কেবিন, লিফট, নতুন প্রযুক্তি; কিন্তু নেই ব্যবহার। বছরের পর বছর রোগীরা বঞ্চিত হচ্ছেন এ সুফল থেকে, আর ভবন পড়ে রয়েছে অযত্নে-অবহেলায়।

হাসপাতালটি ১০০ শয্যার হলেও বাস্তবে এখানকার সেবার চাপ বহন করছে ২৫০ শয্যারও বেশি রোগী। প্রতিদিন ভর্তি থাকেন প্রায় ৩০০ রোগী। আর বহির্বিভাগে প্রতিদিন সেবা নিতে আসেন গড়ে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ মানুষ। এত বিপুল সংখ্যক রোগীর চাপে হাসপাতাল কার্যত হাঁপিয়ে উঠেছে। নেই পর্যাপ্ত বেড, নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও জনবল, নেই পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। ফলে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা যেন যুদ্ধজয়ের চেয়েও কঠিন।


হাসপাতালের এই সংকট নিরসনের লক্ষ্যেই ২০১৮ সালের ৭ জুন শুরু হয় একটি ৯ তলা ও একটি ৬ তলা বিশিষ্ট দুটি নতুন ভবনের নির্মাণকাজ। শুরুতে ব্যয় নির্ধারিত হয় ৩৪ কোটি ৫৩ লাখ ৫৯ হাজার ৫৫০ টাকা। পরবর্তীতে তা বাড়িয়ে ৩৯ কোটি ৭০ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়। ভবনের কাজ শেষ হয় ২০২২ সালের শেষ নাগাদ। এই ভবনগুলোতে রয়েছে ২৫০ শয্যার বিশাল জায়গা, আধুনিক যন্ত্রপাতির সংযোগ ব্যবস্থা, লিফট, কেবিন, উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যসেবার জন্য সব ধরনের প্রাথমিক অবকাঠামো।


কিন্তু বিস্ময়ের বিষয়, এত কিছু থাকা সত্ত্বেও তিন বছরেও শুরু হয়নি সেখানে চিকিৎসাসেবা। ফলে ভবনের নানা যন্ত্রপাতি অচল হয়ে পড়ছে, লিফট জং ধরা শুরু করেছে, ফাঁকা ভবনে ধুলা জমছে। অথচ বাইরে শত শত মানুষ সেবা না পেয়ে দৌড়াচ্ছেন, কেউ কেউ ফিরে যাচ্ছেন নিরাশ হয়ে।


হাসপাতালের এক রোগী, রুজিফা বেগম বলেন, 'তিন দিন ধরে মেঝেতে শুয়ে আছি। একটা দিন ডাক্তার দেখেছেন, এরপর আর কেউ আসেনি। চারপাশে দুর্গন্ধ, গরমে থাকা যায় না।'


আরও পড়ুন: ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিভিন্ন হাসপাতালে অভিযান, কারাদণ্ডসহ চার প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা


বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা কামারজানি এলাকার লোকমান মিয়া বলেন, 'সকাল ৮টায় এসে লাইনে দাঁড়িয়েছি, এখন সাড়ে ১১টা বাজে। এখনও ডাক্তার দেখাতে পারিনি। এত ভিড়, মনে হয় সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে যাবে।'


গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মো. আসিফ বলেন, '১০০ শয্যার একটি ভবনে ২৫০ জনের বেশি রোগীর চিকিৎসা দেওয়া খুবই চ্যালেঞ্জিং। বেড সংকট তো আছেই, তার সঙ্গে রয়েছে জনবলের অভাব। চিকিৎসক ও সেবিকারা প্রচণ্ড চাপের মধ্যে কাজ করছেন।'


হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক (ভারপ্রাপ্ত) ও গাইবান্ধার সিভিল সার্জন ডা. মো. রফিকুজ্জামান বলেন, 'নতুন ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হলেও সেখানে এখনও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, শয্যা ও ফার্নিচার নেই। এসব না থাকায় রোগীদের স্থানান্তর করা সম্ভব হয়নি। বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছে। তবে এখনো চূড়ান্ত বরাদ্দ না আসায় আমরা নিরুপায়।'


আরও পড়ুন: নেই দক্ষ জনবল, ভোলা জেনারেল হাসপাতালে অচল আইসিইউ ও আরটিপিসিআর ল্যাব


স্থানীয় সুশীল সমাজ, জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলছেন, 'যদি ভবন প্রস্তুত করেই ব্যবহার না করা হয়, তাহলে এত কোটি টাকা ব্যয় করে কি লাভ হলো? হাসপাতালের এই ব্যর্থতা কি শুধুই যন্ত্রপাতির অভাবে, নাকি এর পেছনে আছে কোনো প্রশাসনিক গাফিলতি?'


গাইবান্ধা পৌরসভার বাসিন্দা ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম বলেন, 'একদিকে মানুষের চিকিৎসার জন্য হাহাকার, অন্যদিকে আধুনিক ভবন পড়ে আছে খালি। সরকার তো কাজ করেছে, কিন্তু ব্যবস্থাপনা ব্যর্থ।'


এই পরিস্থিতিতে দ্রুত নতুন ভবনটিকে চিকিৎসার উপযোগী করে রোগী স্থানান্তরের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তারা বলছেন, এটা শুধু একটি হাসপাতালের সংকট নয়, এটা গাইবান্ধার লাখো মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন