তায়িফের পথে নবীজির সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাওয়াত
মক্কার কাফিররা যখন একের পর এক অত্যাচার চালাতে থাকে, রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন নতুন সম্ভাবনার খোঁজে বের হন। তায়িফ ছিল একটি সম্ভাবনাময় শহর। তিনি তায়িফের সাকিফ গোত্রের নেতাদের কাছে ইসলামি দাওয়াত পৌঁছে দিতে যান। ইবনু ইসহাক ও ইবনু হিশাম বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে আব্দে ইয়ালাইল, মাসউদ ও হাবিব নামের তিন নেতার কাছে দাওয়াত পেশ করেন। কিন্তু তারা শুধু প্রত্যাখ্যানই করেননি, তাকে অপমানিতও করেন। কেউ ব্যঙ্গ করে বলল,
আল্লাহ কি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে পেলেন না? আরেকজন তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, তুমি যদি সত্যিই নবী হও, তবে আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই না। আর যদি মিথ্যাবাদী হও, তবে আমার সাথে কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই। (সিরাতু ইবনি হিশাম: ২/২৮)
পাথর ও রক্তের সাক্ষী সেই দিন
এই অপমানও যথেষ্ট ছিল না। তারা শহরের বখাটে ছেলেদের, দাসদের ও দাসীদের রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে ঘিরে ধরতে পাঠায়। তারা দুই সারি করে দাঁড়িয়ে পাথর ছুঁড়তে থাকে। সিরাতু ইবনি হিশাম ও সহিহ বুখারিতে এসেছে, এত বেশি আঘাতের ফলে নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পা থেকে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিল। নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সঙ্গে থাকা হজরত যায়েদ ইবনু হারিসা রা.ও আহত হন।
আরও পড়ুন: যেভাবে আল আকসা বিজয় করেছিলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবি রহ.
রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্লান্ত শরীরে এক বাগানে আশ্রয় নেন, যা উতবা ও শাইবা ইবনু রাবিয়ার মালিকানাধীন ছিল। সেখানে তিনি তার দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে আল্লাহর কাছে এক হৃদয়বিদারক দুআ করেন।
নবীজির অশ্রুসিক্ত দোয়া
নবীজির সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই দুআ সিরাতের কিতাবগুলোতে এমনভাবে এসেছে যে, পাঠকের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে যায়, اللَّهُمَّ إِلَيْكَ أَشْكُو ضَعْفَ قُوَّتِي، وَقِلَّةَ حِيلَتِي، وَهَوَانِي عَلَى النَّاسِ হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছেই অভিযোগ করছি আমার দুর্বলতার, আমার অসহায়ত্বের এবং মানুষের কাছে আমার হীনতার। يَا أَرْحَمَ الرَّاحِمِينَ، أَنْتَ رَبُّ الْمُسْتَضْعَفِينَ وَأَنْتَ رَبِّي হে পরম দয়ালু! তুমি নিপীড়িতদের রব, তুমি-ই আমার রব। (সিরাতু ইবনি হিশাম: ২/ ২৯) এই দুআ নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিনয়, ধৈর্য ও আল্লাহর ওপর পূর্ণ নির্ভরতার অনন্য দৃষ্টান্ত।
ফেরেশতাদের প্রস্তাব ও নবীজির ক্ষমাশীলতা
তখন আল্লাহ তাআলা জিবরাইল আ.কে পাঠালেন। সহিহ বুখারিতে এসেছে,
فَإِذَا مَلَكُ الْجِبَالِ يَدْعُوهُ فَسَلَّمَ عَلَيْهِ، ثُمَّ قَالَ: إِنَّ اللَّهَ قَدْ سَمِعَ قَوْلَ قَوْمِكَ لَكَ، وَقَدْ بَعَثَنِي رَبُّكَ إِلَيْكَ لِتَأْمُرَنِي بِأَمْرِكَ، إِنْ شِئْتَ أَنْ أُطْبِقَ عَلَيْهِمُ الْأَخْشَبَيْنِ পাহাড়ের ফেরেশতা এসে সালাম দিলেন এবং বললেন, ‘হে মুহাম্মাদ, আল্লাহ আপনার সম্প্রদায়ের কথা শুনেছেন। আমি প্রেরিত হয়েছি আপনার আদেশের অপেক্ষায়। আপনি চাইলে আমি তায়িফের দুই পাহাড়ের মধ্যে তাদের চাপা দিয়ে ধ্বংস করে দেব। (সহিহ বুখারি:৩০৫৯)
কিন্তু রসুলুল্লাহ রহমতের প্রতীক
بَلْ أَرْجُو أَنْ يُخْرِجَ اللَّهُ مِنْ أَصْلَابِهِمْ مَنْ يَعْبُدُ اللَّهَ وَحْدَهُ না, আমি আশা করি আল্লাহ তাদের বংশধরদের মধ্য থেকে এমন লোক বের করবেন, যারা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে। (সহিহ বুখারি:৩০৫৯) এটি নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অতুলনীয় ধৈর্য, দয়া ও ক্ষমাশীলতার অনন্য উদাহরণ।
আয়াতের আলোকে তায়িফের শিক্ষা
কুরআনে আল্লাহ তাআলা তার প্রিয় নবী-কে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন,
فَاصْبِرْ صَبْرًا جَمِيلًا অতএব, তুমি ধৈর্য ধারণ করো সুন্দর ধৈর্য সহকারে। (সুরা মাআরিজ ৭০:৫) তায়িফের এই ঘটনাই ধৈর্যের সর্বোচ্চ মানদণ্ড স্থাপন করেছে।
আজকের জন্য শিক্ষণীয় দিক তায়িফের এই ঘটনা আমাদের শেখায়
দাওয়াতের পথ কখনো সহজ নয়, তবুও দৃঢ় থাকতে হবে। অন্যের অত্যাচারের প্রতিক্রিয়ায় প্রতিশোধ নয়, বরং হিদায়াতের জন্য দুআ করতে হবে। নবীজির সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রহমত ও ক্ষমাশীলতার আদর্শ আমাদের জীবনে প্রযোজ্য।
তায়িফের পথে নবীজির দাওয়াত ছিল এক ভালোবাসার আহ্বান, আর তার রক্তাক্ত শরীর ছিল ধৈর্য ও ত্যাগের সাক্ষ্য। ফেরেশতারা শহর ধ্বংসের প্রস্তাব দিলেও তিনি ক্ষমার দুআ করলেন। এটাই ছিল তার জীবনের মূল বার্তা,মানবতার জন্য রহমত।
]]>