তালাকের বিষয়ে ইসলামের ভাবনা ও সমাজে প্রচলিত ভ্রান্তি

২ ঘন্টা আগে
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা, যেখানে পারিবারিক সম্পর্কের সুন্দর ব্যাখ্যা ও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিবাহ যেমন পবিত্র একটি বন্ধন, তেমনি প্রয়োজনে তালাকের বিধানও শরীয়তে অনুমোদিত। তবে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল একটি বিষয়, যা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে প্রয়োগযোগ্য।

কিন্তু আমাদের সমাজে তালাকের সঠিক নিয়ম-কানুন না জানার কারণে অনেকেই শরীয়তের সীমা লঙ্ঘন করছে। এর ফলে পারিবারিক সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে এবং সমাজে অশান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। এই প্রবন্ধে তালাকের শরীয়তসম্মত বিধান এবং সমাজে প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো তুলে ধরা হয়েছে।


সমাজে তালাক সংক্রান্ত ভ্রান্তি ও তার প্রভাব

 

তালাকের বিধান কোরআনুল কারিমে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, 

 

তালাক (রাজঈ) হলো দুইবার পর্যন্ত। এর পর হয় নিয়ম অনুযায়ী স্ত্রীকে রাখবে, না হয় সুন্দরভাবে বিদায় দেবে। (সুরা বাকারা ২২৯-২৩০) এই বিধান পরিষ্কারভাবে তালাকের সীমা-পরিসীমা নির্দেশ করে।

 

কিন্তু আমাদের সমাজে তালাকের বিষয়ে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত। যেমন—অনেকেই মনে করে রাগের সময় তালাক দিলে তা কার্যকর হয় না, সাক্ষী ছাড়া তালাক হয় না, কিংবা মৌখিক তালাককে তালাক বলে গণ্য করা যায় না। এর পাশাপাশি সবচেয়ে বড় ভুল হলো, এক-দুই তালাকের ক্ষেত্রে মানুষ মনে করে এটি কার্যকর নয়; তাই একসঙ্গে তিন তালাক দিতে হবে। এ ধারণার ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তালাক হয়ে যায় তিন তালাক, যা পুনর্মিলনের সব পথ বন্ধ করে দেয়।

 

আরও পড়ুন: বেকারত্বের হতাশা থেকে মুক্তি পেতে ইসলামের নির্দেশনা

 

মনে রাখতে হবে, তালাক আর মৃত্যু একই। মরে গেলে যেমন ফিরে আসে না। তালাক দিলেও সেটাকে ফেরানোর কোনো পথ নাই। তালাক বললে তালাক পতিত হয়েই যাবে। তাই এ শব্দ থেকেই আমাদের সাবধান থাকতে হবে। 


তালাকের অপব্যবহার কেবল স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ধ্বংস করে না, বরং তাদের সন্তানদের জীবনকেও বিষাদময় করে তোলে। অনেক ক্ষেত্রে তালাকের পর স্বামী-স্ত্রী নিজেদের ভুল বুঝতে পারে, কিন্তু তখন আর কিছু করার থাকে না। ফলে উভয়ের জীবনে আসে এক গভীর হতাশা ও অনুশোচনা।


কিন্তু আমাদের সমাজে বিভিন্ন বিষয়েই বহু ভুল-ভ্রান্তি বিস্তার করে আছে। নিত্য নতুন ভ্রান্তির উদ্ভবও হচ্ছে। তালাকের ব্যাপারে যে ভ্রান্তিগুলো আমাদের সমাজে বিরাজমান তা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। এসব ভ্রান্তির কারণে মানুষ কত যে অন্যায় অবৈধ কাজে জড়িয়ে পড়ে তার সীমা-পরিসীমা নেই। মানুষ তালাককে রাগ প্রশমনের হাতিয়ার মনে করে। যখন তখন সামান্য ঝগড়ার কারণে তালাক দিয়ে ফেলে।


আবার কেউ কেউ বোঝানোর চেষ্টা করে, রাগের অবস্থায় তালাক দিলে তালাক হয় না। একাকি তালাক দিলে তালাক হয় না। শুধু লিখিত দিলে, মৌখিকভাবে না বললে তালাক হয় না। সাক্ষীর উপস্থিতি না থাকলে তালাক হয় না। স্ত্রী না জানলে তালাক হয় না। তালাকনামা স্ত্রী গ্রহণ না করলে তালাক হয় না ইত্যকার সব গর্হিত কথাবার্তা যার স্বপক্ষে না আছে কোনো গ্রহণযোগ্য দলীল-প্রমাণ আর না আছে শরীয়ত স্বীকৃত কোনো যুক্তি।


এ ব্যাপারে সবচেয়ে বড় ভ্রান্তি হলো, মানুষ তিন তালাকের কম এক-দুই তালাককে তালাকই মনে করে না। তালাক দিলে তিন তালাকই দিতে হবে। আমাদের সমাজ এমনটিই মনে করে। এজন্যে সাধারণত তিন তালাকের কম কেউ তালাক দেয় না। পক্ষান্তরে এর চেয়ে বেশি দেওয়া হয়।


মূর্খ, শিক্ষিত, ধনী, গরিব সকলেই এই ভ্রান্তির শিকার। তালাক লিখিত আকারে দেওয়া হোক বা মৌখিক, স্ত্রী এক সাথে তিন তালাক দিয়ে ফেলে। এ অধিকন্তু স্বামী যদি এক তালাক দেয় তাহলে তাকে আরো উত্তেজিত করে এ তোলা হয়। বিভিন্ন কটু কথা বলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়, যাতে সে তিন তালাক দিতে বাধ্য হয়। মোটকথা, যে পর্যন্ত স্বামী তিন তালাক না দেবে, স্বামীর রাগ দমন হবে না, স্ত্রীর রাগও কমবে না।


পরিবার-পরিজনদের ক্রোধেও ভাটা পড়বে না। তখন বাচ্চাদের কথাও স্মরণ হবে না। ঘর বিরান হওয়ার কথা মনে পড়বে না। যখন স্বামী তালাকের তিনো গুলি ছুঁড়ে মারবে, তখন সবার রাগ ঠাণ্ডা হয়ে যায়। সকলের হুঁশ ফিরে আসে।

 

তালাকের পর যখন ঘর সংসার বিরান হয়ে যায়। ছোট ছোট বাচ্চাদের করুণ চেহারা স্মৃতিপটে ভেসে উঠে। তখন সমস্ত ভুল বুঝে আসে, লজ্জিত হয়। কান্নাকাটি শুরু করে। কিন্তু তখন আর এ অনুশোচনা, কান্নাকাটি কাজে আসে না। তিন তালাক হয়ে গেছে। বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে। তালাকের অবৈধ প্রয়োগের ফলাফল এখন স্বামী-স্ত্রী পৃথক হয়ে যাওয়া। উপরন্তু যদি কোনো শরয়ি কারণ ছাড়া তালাক দেয়া হয় তাহলে এ জুলুমের গোনাহ তো আছেই।

 

তালাক দেয়ার ইসলামি নিয়ম

 

যদি দাম্পত্য মীমাংসার পর্যায়ক্রমিক সব চেষ্টাই সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয় এবং তালাক প্রদানের সিদ্ধান্তই গৃহিত হয়, তাহলে পবিত্র কোরআন নির্দেশ দিয়েছে স্বামীকে উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করতে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপযুক্ত সময়ের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তা হলো, মাসিক ঋতুস্রাব থেকে মুক্ত হওয়া এমন পবিত্রতা, যে পবিত্রতায় স্বামী-স্ত্রী সহবাস হয়নি। 

 

এমন পবিত্রতার সময়ে স্ত্রীকে তালাক দিতে হবে। মাসিক চলাকালে তালাক প্রদান শরীয়তের দৃষ্টিতে গোনাহের কাজ। তেমনি যে পবিত্রতায় স্বামী-স্ত্রীর দৈহিক মিলন হয়েছে তাতেও তালাক দেওয়া বৈধ নয়। এমতাবস্থায় তালাক প্রদানের জন্য স্বামীকে পরবর্তী মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

 

আরও দেখুন: বিশ্বজয় করা মুয়াজ মাহমুদের জীবনের গল্প

 

তালাক শরিয়ত অনুমোদিত একটি বৈধ পদ্ধতি, তবে এটি অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সঙ্গে প্রয়োগ করতে হয়। এটি কোনো রাগ প্রশমনের হাতিয়ার নয়, বরং একান্ত প্রয়োজনে শরীয়তের নির্দেশনা মেনে তালাক কার্যকর করতে হবে। সমাজের প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণাগুলো দূর করার জন্য আমাদের শরীয়ত সম্মত জ্ঞান অর্জন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

সঠিক জ্ঞান ও সচেতনতার অভাবে তালাকের অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব নয়। তাই পরিবার এবং সমাজকে রক্ষা করতে হলে, এই বিষয়ে ইসলামের নীতিমালা যথাযথভাবে জানা ও তা মেনে চলা জরুরি। তবেই আমরা তালাকের অপব্যবহার বন্ধ করে শান্তিপূর্ণ ও সুখী সমাজ গড়ে তুলতে পারব।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন