এদিকে, পরিবহন করতে গিয়েও পথেই মারা পড়ছে পোনা। কোনোভাবেই তাল মেলাতে পারছেন না হ্যাচারি মালিক ও ব্যবসায়ীরা। এতে খাত সংশ্লিষ্টদের গচ্চা দিতে হচ্ছে মোটা অংকের টাকা।
দেশে রেণু পোনা উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে যশোর। এ অঞ্চলে ফাল্গুন মাস থেকে শুরু হয় রেনু উৎপাদনের মৌসুম। এরপর মধ্য আষাঢ় পর্যন্ত চলে রেণু পোনা উৎপাদন ও বিপণন। কিন্তু গত কদিন ধরে এ অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তীব্র তাপপ্রবাহে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে রেণু পোনা ও চারা মাছ উৎপাদনে।
সরেজমিনে দেখা যায়, অধিকাংশ হ্যাচারিতেই নেই রেণু। তীব্র তাপে খাঁ খাঁ করছে হ্যাচারিগুলো। বৃষ্টির অভাব ও ভূগর্ভস্থ পানির লেয়ার নেমে যাওয়ায় পানিশূন্য হয়ে পড়ছে পুকুরগুলো। এসব পুকুরের সামান্য পানিতে রেণু ও ধানি পোনা দিলে তা মারা যাচ্ছে গরমে। এতে করে আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন এ ব্যবসার সাথে জড়িত হাজার হাজার মানুষ।
আরও পড়ুন: সাতক্ষীরায় চিংড়ি রেণুর দাম বেড়ে গেছে দ্বিগুণেরও বেশি, চাষিরা দিশেহারা!
মাতৃ ফিশ হ্যাচারির মালিক জাহিদুর রহমান গোলদার বলেন, ‘প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের কারণে উৎপাদন ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। কোনো রকমে আমরা মার্কেটে টিকে আছি। গরমের কারণে মাঠে কর্মচারীরা কাজ করতে পারছে না। যারা কাজ করছে তাদের পারিশ্রমিক দেয়ার মত ব্যবসাও হচ্ছে না।’
তিনি আরো বলেন, গরমের সময় আমরা ভূ-গর্ভস্থ পানি তুলে কাজ করতাম। এখন পানির স্তর এত নেমে গেছে যে পানিও উঠছে না। তেল বা বিদ্যুৎ খরচটা বৃথা যাচ্ছে। এ অবস্থায় আমরা সমস্ত মাছ ব্যবসায়ীরা চরম ক্ষতিগ্রস্ত।
সন্ধি হ্যাচারির মালিক আলী হোসেন বলেন, ‘এ গরমে মাছের রেণু উৎপাদন, চাষ ও বিপণন সবকিছু বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কিছু রেণু ও ছোট মাছ উৎপাদন করছি। সেগুলো দূরের জেলায় পাঠাতে গেলে পথেই মারা যাচ্ছে। হাউসে রাখলে মাছের স্ট্রোক হচ্ছে। এসব কারণে এ বছর ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ।’
যশোরের রেণু ও পোনা মাছ বিপণন কেন্দ্রের ব্যবসায়ী শেখ বাবু আলী বলেন, ‘রেণু ও পোনা মাছ উৎপাদন এবং বিপণন মৌসুম এপ্রিলে শুরু হয়। যে তাপ পড়ছে তাতে মাছ উৎপাদন হচ্ছে না। পুকুরগুলো ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। পুকুরগুলোতে পাম্প করে পানি ধরে রাখতে হচ্ছে। তারপরও ওই পানিতে মাছ দিলে তা মারা যাচ্ছে। আমরা খুব দুর্ভোগে আছি। এভাবে থাকলেও আমাদেরও মরার উপক্রম হবে।’
হ্যাচারি কর্মী আব্দুর রহমান বলেন, সিজনে প্রচুর মাছ বিক্রি হয়। কিন্তু গরমের কারণে মাছ বিক্রি নেই। এ বছর শুরুতেই আমরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছি।
হ্যাচারি কর্মী রায়হান আলী বলেন, স্বল্প দূরত্বে ব্যারেলে মাছ টানতে কোনো সমস্যা হয় না। তবে গরমের কারণে এখন অক্সিজেন দিয়ে মাছ পরিবহন করতে হচ্ছে। তারপরও অনেক মাছ মারা যাচ্ছে।
বরিশাল থেকে মাছের পোনা নিতে এসেছিলেন সালাম শিকদার। তিনি বলেন, সকালে এসে বাজারে মাছ দেখতে পাইনি। এত গরমে হ্যাচারি মালিকরা পর্যাপ্ত মাছ উৎপাদন করছে না। কারণ মাছ মরে যাচ্ছে। কয়েক হ্যাচারি ঘুরে মাছ পেয়েছি। কিন্তু সেই মাছ যে অক্সিজেন দিয়ে নিয়ে যাবো সে সাহস হচ্ছে না।
এদিকে, হ্যাচারি মালিক নেতাদের দাবি সহসা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে মৎস্য উৎপাদনে জাতীয় বিপর্যয় দেখা দেবে।
যশোর জেলা মৎস্য হ্যাচারি মালিক সমিতি সভাপতি আলহাজ্ব ফিরোজ খান বলেন, ‘তাপপ্রবাহের কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। মাছের রেণু উৎপাদনের জন্য সহনীয় তাপমাত্র ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু বর্তমানে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে। ফলে মাছ থেকে ডিম সংগ্রহ করে রেণু উৎপাদনের জন্য জারে নিলেও তা পরিপূর্ণভাবে পরিষ্ফুটিত হচ্ছে না। অর্ধেকের বেশি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমি মনে করি, এ তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকলে মৎস্য উৎপাদনে জাতীয় বিপর্যয় দেখা দেবে। বিশেষ করে আমরা যে লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছি, তা কোন অবস্থাতেই অর্জন করা সম্ভব হবে না।’
আরও পড়ুন: দেশে প্রথমবারের মতো পুকুরে গলদা চিংড়ির রেণু উৎপাদন
হ্যাচারি মালিক সমিতির দেয়া তথ্য মতে, যশোরের ৩৬টি হ্যাচারিতে বছরে কমবেশি দেড় লাখ কেজি রেণু উৎপাদন করা হয়, যার বাজার মূল্য ৩শ কোটি টাকার মতো।
]]>