জনপ্রিয় নেতা ট্রুডো!
জাস্টিন ট্রুডো ২০১৫ সালে যখন প্রথমবারের মতো ক্ষমতা নেন, তখন কানাডা তো বটেই বিশ্ববাসীরও নজর কাড়েন। ২০১৯ এবং ২০২১ সালে তার দল লিবারেল পার্টিকে ব্যালট যুদ্ধে বড় জয় উপহার দেন। জাস্টিন ট্রুডোর বাবা ছিলেন কানাডার ক্যারিশম্যাটিক রাজনীতিবিদ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো। ২০০০ সালে মারা যান তিনি।
স্নোবোর্ড প্রশিক্ষক, বারটেন্ডার এবং শিক্ষক হিসেবে কাজ করার পর রাজনীতিতে আসেন জাস্টিন ট্রুডো। ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো হাউস অব কমন্সে মন্ট্রিলের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য নির্বাচিত হন তিনি। তবে তার টার্নিং পয়েন্ট বিবেচনা করা হয় ২০১২ সালকে। সে বছর একটি মুষ্টিযুদ্ধ ম্যাচে প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ দলের কারাতে ব্ল্যাক বেল্ট পাওয়া এক নেতাকে হারান ট্রুডো। সেই ঘটনা তার রাজনৈতিক জীবনে উত্থান ও জনপ্রিয়তার অন্যতম বড় কারণ।
আরও পড়ুন: পদত্যাগের ঘোষণা জাস্টিন ট্রুডোর
ট্রুডো সিনেটকে সংশোধনে নানামুখী পদক্ষেপ নেন। বিশেষ করে দলীয় নিয়োগের অবসান এবং একটি স্বাধীন, যোগ্যতা ও মেধাভিত্তিক নির্বাচন প্রক্রিয়া তৈরি করে সিনেটকে কম রাজনীতিকরণ ও আরও স্বচ্ছ করা লক্ষ্য ছিল তার। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম দুই মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি নতুন বাণিজ্য চুক্তি সই করেন ট্রুডো, সেইসঙ্গে কানাডার গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে কার্বন কর প্রবর্তন করেন। সবশেষ যখন পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন, সেই বক্তব্যেও বিভিন্ন অর্জন তুলে ধরেছেন জাস্টিন ট্রুডো।
কী ধরনের চাপে ছিলেন ট্রুডো?
বিশ্বব্যাপী প্রগতিশীল রাজনীতির একসময়ের উদীয়মান তারকা জাস্টিন ট্রুডোর গ্রহণযোগ্যতা গত বছরের শেষের দিকে ৩৩ শতাংশে নেমে আসে। একই জরিপে অর্থনৈতিক অস্বস্তি নিয়ে ব্যাপক হতাশা প্রকাশ করেন কানাডীয়রা।
পশ্চিমা অনেক দেশের মতো কানাডাকেও রেকর্ড মুদ্রাস্ফীতি এবং উচ্চ খাদ্যমূল্যের ভার বহন করতে হয়। যে দায় পড়ে ট্রুডোর ঘাড়ে। আবাসন সংকটের কারণে কিছু অঞ্চলে সাম্প্রতিক বছরে বাড়ির দাম ৩০-৪০ শতাংশ বেড়েছে, যা সরকারের প্রতি ক্ষোভ আরও গভীর করেছে। ক্ষমতার দীর্ঘ মেয়াদে রাজনৈতিক কেলেঙ্কারিও কম হয়নি। উপহার গ্রহণ, ছুটির দিন এবং ব্যক্তিগত হেলিকপ্টার ফ্লাইট নিয়ে তুমুল সমালোচনার মুখোমুখী হন ট্রুডো।
আরও পড়ুন: ট্রুডোর পদত্যাগ /কানাডাকে ফের ৫১তম অঙ্গরাজ্য বানানোর প্রস্তাব ট্রাম্পের
২০১৭ সালে নৈতিকতাবিষয়ক একটি কমিশন জানায়, বিনামূল্যে জাঁকজমকপূর্ণ এক ছুটি কাটিয়ে ও বিষয়টি প্রকাশ না করে ২০১৬ সালে স্বার্থসংঘাত সংশ্লিষ্ট নিয়ম ভেঙেছেন ট্রুডো। সার্ফিং অবকাশের জন্য দেশের জাতীয় দিবস এড়িয়ে যাওয়া এবং ট্রুডোর পরিবারের সদস্যরা একটি দাতব্য সংস্থার কয়েক হাজার ডলার গ্রহণ করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে, যা ট্রুডোকে বেকায়দায় ফেলে।
এখন কেন পদত্যাগের ঘোষণা?
কানাডার কেন্দ্রীয় অধীনে ২০২৫ সালের অক্টোবরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক মাসে লিবারেল পার্টির সদস্যরা মূল্যায়ন করছেন, জাস্টিন ট্রুডোর সরে যাওয়া এবং নতুন কাউকে আনার সময় হল কি না।
গত বছরের শেষের দিকে, প্রায় ২৪ জন লিবারেল আইনপ্রণেতা প্রধানমন্ত্রীকে সম্ভাব্য পরাজয় এড়াতে পদত্যাগ করার আহ্বান জানিয়ে একটি চিঠিতে সই করেন। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্তও মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল পরিস্থিতি। কিন্তু এ সময় ট্রাম্পের এক মন্তব্যের পর নাটকীয়ভাবে পদত্যাগ করেন কানাডার উপ-প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে জাস্টিন ট্রুডো ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবেন কি না, সে প্রশ্ন রেখে যান তিনি।
আরও পড়ুন: যেসব কারণে পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন ট্রুডো, উত্তরসূরির আলোচনায় যারা
ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ডের পদত্যাগের ক’দিন পরেই আটলান্টিক কানাডা, অন্টারিও এবং কুইবেকের লিবারেল আইন প্রণেতারাও বলতে শুরু করেন, এবার বুঝি নতুন নেতা বেছে নেয়ার সময় এসেছে।
ট্রাম্প কীভাবে জড়িত?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দ্বিতীয় মেয়াদে জয়ী হওয়ার পরপরই নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, কানাডার ওপরও ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার কানাডা। তাই ট্রাম্পের এমন হুমকির পর তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড সতর্ক করে বলেন, ট্রাম্পের হুমকিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নেওয়া উচিত।
হুমকি-ধামকির মধ্যেই আবার কানাডাকে নিয়ে নানাভাবে রসিকতাও করতে থাকেন ট্রাম্প। তিনি ট্রুডোকে ‘গ্রেট স্টেট অব কানাডার’ ‘গভর্নর’ বলে অভিহিত করে উপহাস করেন। কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম অঙ্গরাজ্য হওয়ারও প্রস্তাব দেন ট্রাম্প। কানাডা কোনো সার্বভৌম দেশ নয় বলে মন্তব্য করেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ট্রুডোর বিরুদ্ধে অপমানজনক মন্তব্য করতে থাকেন ট্রাম্প। ট্রুডোকে কানাডার গভর্নর বলে অভিহিত করার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর প্রতিবেশী হিসেবে কানাডার ৫১তম অঙ্গরাজ্যের ধারণা বাস্তবায়নের তাগাদা দিতে থাকেন নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট। মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্কসহ ট্রাম্পের বেশ কয়েকজন ঘনিষ্ঠও সামাজিক মাধ্যমে ট্রুডোকে আক্রমণ শুরু করেন।
আরও পড়ুন: ট্রুডোর পদত্যাগ /কানাডার পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর আলোচনায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত অনিতা
জাস্টিন ট্রুডোর পদত্যাগের ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্প এরইমধ্যে বলেছেন, কানাডার জনগণ নিজের দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য হিসেবে দেখতে চায়। আর এ বিষয়টি বুঝতে পেরেই পদত্যাগ করেছেন ট্রুডো।
সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশালে তিনি বলেন, ‘কানাডার অনেক মানুষ মনেপ্রাণে যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম অঙ্গরাজ্যে পরিণত হতে চায়। কানাডার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রকে পর্বতসম বাণিজ্য ঘাটতি ও ভর্তুকি দিতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রকে এই ভার বহন করতে হচ্ছে। জাস্টিন ট্রুডো এ বিষয়গুলো জানতেন এবং এ কারণেই পদত্যাগ করেছেন।’
এরপর কী?
কানাডার রাজনৈতিক সংকটের জেরে আগামী ২৪ মার্চ পর্যন্ত পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত করা হয়েছে। সাধারণত রাজনৈতিক সংকটের সময় পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত করা হয়। এর ফলে পার্লামেন্ট না ভেঙেই দেশে বিতর্ক বা ভোটাভুটি বন্ধ রাখা যায়। ২০২০ সালেও বিশেষ এক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত করেন ট্রুডো।
২৪ মার্চের আগেই লিবারেল পার্টি নতুন নেতা নির্বাচন করার কথা রয়েছে। আর আইন অনুযায়ী নির্বাচন হওয়ার কথা এ বছরের অক্টোবরের মধ্যেই। এরইমধ্যে পরবর্তী নেতা নির্বাচনে তোড়জোড় শুরু করেছে দলটি। সাধারণত চার-পাঁচ মাসের একটি লম্বা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দলের নতুন নেতা নির্বাচন করা হয়। তবে এবার এত সময় পাওয়া যাবে না। যে কারণে প্রচণ্ড প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে নতুন নেতা নির্বাচন।
আরও পড়ুন: কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য হওয়ার পরামর্শ ট্রাম্পের, যা বললেন ট্রুডো
কানাডার রাজনৈতিক ব্যবস্থায় হাউস অব কমন্সের সবচেয়ে বড় দল হিসেবে যিনি লিবারেল পার্টির প্রধান হবেন, দেশটির প্রধানমন্ত্রীও হবেন তিনিই। লিবারেল পার্টির নেতা হওয়ার দৌঁড়ে এগিয়ে আছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড, ট্রুডোর বন্ধু ডমিনিক লেব্ল্যাঁ, শীর্ষ কূটনীতিক মেলানি জলি ও ব্যাংক অব কানাডার সাবেক গভর্নর মার্ক কার্নি।
]]>