টিএসসিতে শিবিরের প্রদর্শনীতে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত নেতাদের ছবি নিয়ে উত্তেজনা

১ সপ্তাহে আগে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত নেতাদের ছবি প্রদর্শন নিয়ে বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীদের মাঝে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। পাল্টাপাল্টি স্লোগান দিচ্ছে দুই পক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমেদসহ প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করছেন।

জানা গেছে, মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) ঢাবির ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসটি) আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে ছাত্র শিবির। সেখানে ‘বিচারিক হত্যাকাণ্ড’ শিরোনামে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা, সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল যুদ্ধাপরাধী মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, সাবেক শুরা সদস্য মীর কাসেম আলী, সাবেক নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং বিএনপির সাবেক স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছবি স্থান পায়।


বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে তারা সবাই একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন। তাদের মধ্যে আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী কারাগারে মারা যান। বাকি ছয় জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয় ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের মত মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ ‘প্রমাণিত’ হয়েছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমির গোলাম আযমকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কারাগারে থাকা অবস্থায় ২০১৪ সালে তার মৃত্যু হয়। তবে শিবিরের এই প্রদর্শনীতে তার ছবি রাখা হয়নি।


শুরু থেকেই ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া প্রত্যাখ্যান করে আসছে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির। তাদের দাবি, তাদের এই নেতারা আওয়ামী লীগের আমলে ‘বিচারিক হত্যাকাণ্ডের’ শিকার।


ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উদ্যোগে মঙ্গলবার সকালে চিত্র প্রদর্শন কর্মসূচি শুরু হয়। এতে স্থান পায় ছয় নেতার ছবি। বিষয়টি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সন্ধ্যার কিছু আগে সেখানে উপস্থিত হয়ে ছবিগুলো সরিয়ে ফেলার দাবি জানান বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা। খবর পেয়ে সেখানে প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা আসেন এবং এক পর্যায়ে ছবিগুলো নামিয়ে ফেলেন।

 

আরও পড়ুন: ছাত্রলীগে লুকিয়ে থাকা শিবিরকে বাঁচানোর অভিযোগ নিয়ে যা বললেন সাদিক কায়েম

 

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী রাফিজ খান বলেন, ‘নিজামী-সাঈদির মতো জামায়াতের সাবেক শীর্ষ নেতাদের যে ছবিগুলো আজকে টিএসসিতে প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছিল সেগুলো সরানোর জন্য বাম সংগঠনের পক্ষ থেকে চাপ তৈরি করা হয়েছিল। এই চাপের মুখেই সেই ছবিগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়। টিএসসিতে শিবিরের যে কার্যক্রমগুলো চলছে সেটাও আজকের জন্য বন্ধ করে দেওয়ার একটা দাবি তোলা হয় বাম সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে। প্রক্টর স্যার বিষয়টিতে রাজি না হওয়ায় শিবিরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দিতে শুরু করে বাম সংগঠনের নেতাকর্মীরা। বাম সংগঠনের সঙ্গে পরে যোগ দেয় বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) এর নেতারাও। তাতক্ষণিকভাবে কার্যক্রম বন্ধ করাসহ তারা প্রক্টর বরাবর ৪ দফা দাবি উত্থাপন করেন। সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে টিএসসিতে এখন উত্তেজনা বিরাজ করছে।

 

দাবিগুলো হলো- ১. তাৎক্ষণিক যুদ্ধপরাধীদের ছবি সরিয়ে নিয়ে আয়োজনটি বন্ধ করতে হবে; ২. এমন কর্মকান্ডের জন্য ছাত্রশিবিরকে জনসম্মুখে ক্ষমা চাইতে হবে; ৩. পরবর্তীতে এমন কর্মকান্ড যেন না ঘটে তার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে এবং ৪. বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উপস্থিতিতে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা কীভাবে ঘটেছে তার ব্যাখ্যা এবং ক্ষমা চাইতে হবে।

 

 

এদিকে প্রতিবেদন লেখার সময়ও টিএসসির বাইরে বাম দলগুলো বিভিন্ন রকম স্লোগান দিচ্ছে। ‘তুমিও জানো আমিও জানি, শিবির মানেই পাকিস্তানি’, ‘৭১ হারেনি, হেরে গেছে রাজাকার’, ‘২৪ হারেনি, হেরে গেছে রাজাকার’, ‌‘আমার মাটি আমার মা, রাজাকারের হবে না’- এমন স্লোগান দিতে শোনা যায় তাদের। অপরদিকে শিবিরের নেতাকর্মীরা টিএসসির ভেতরে স্লোগান দিচ্ছেন। ‘সাঈদীর বাংলায়, শাহবাগীদের ঠাই নাই’, ‘সাকা চৌধুরীর বাংলায়, শাহবাগীদের ঠাই নাই’, ‘কাদের মোল্লার বাংলায়, শাহবাগীদের ঠাই নাই’, ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’- স্লোগান দিতে শোনা যায় তাদের।

 


তবে জুলাই উদযাপনের অনুষ্ঠানে শিবিরের এমন আয়োজন নিয়ে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২২-২৩ সেশনের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী নওরিন সুলতানা তমা সময় সংবাদকে বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে মনে করি, গণুভ্যত্থানের দিনে এ ধরনের একটি আয়োজনের মাধ্যমে মূলত তারা (ছাত্রশিবির) '২৪ এবং '৭১-কে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে একটা রাজনীতি করতে চেয়েছিল। এটার মাধ্যমে আসলে ২৪-কে তো অপমান করা হয়েছেই ৭১-কেও অপমান করা হয়েছে। এখানে তারা নিজামীর মতো চিহ্নিত রাজাকারদের ছবি রেখেছে যেটা খুবই লজ্জাজনক। এটার প্রতি আমার তীব্র ঘৃণা। আর সেই ঘৃণা থেকেই এটার বিরুদ্ধে সেখানে উপস্থিত ছিলাম।”

 

আরও পড়ুন: গণ-অভ্যুত্থান স্মরণে ছাত্রশিবিরের ‘জুলাই র‌্যালি’


এই ক্ষোভের বিষয়ে ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এস এম ফরহাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল অনলাইন সংবাদমাধ্যম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। সংবাদমাধ্যমটিকে ফরহাদ বলেন, “একাত্তর বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। এটাকে কোনো ছাত্র সংগঠন অস্বীকার করার সুযোগ নাই।’’

 

আমরা দেখেছি শেখ হাসিনার স্কাইপি কেলেঙ্কারি, হাসিনা নিজের মত করে বিচার ব্যবস্থাকে সাজিয়েছে। ইচ্ছামত রায় দিয়েছে। সাক্ষীকে গুম করে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছে, আইনজীবীকে গুম করে আয়নাঘরে বন্দি রেখে নির্যাতন করেছে। তাই, আমরা এটাকে ‘বিচারিক হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে রেখেছি।


তিনি বলেন, “ফ্যাসিবাদী আমলে যা যা ঘটেছে, আমরা সবকিছুকে আনার চেষ্টা করেছি। তাই আমরা এটাকে সামনে রেখেছি। এ বিচার ব্যবস্থা সুষ্ঠু নয়। এটা যদি নিরপেক্ষ হত আমরা মেনে নিতাম। কিন্তু আওয়ামী লীগের আমলে যে বিচার ব্যবস্থা তা প্রশ্নবিদ্ধ।


শিবিরের তিন দিনব্যাপী আয়োজন শেষ হবে আগামী ৭ অগাস্ট। এতে থাকবে জুলাইয়ের চিত্র প্রদর্শনী, জুলাই বিপ্লব নিয়ে ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী, বিপ্লবের গান ও কবিতা, শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধাদের গল্প, গান, কবিতা, প্লানচেট বিতর্ক ও আলোচনা সভা। এর আংশ হিসেবে টিএসসিতে তৈরি করা হয়েছে প্রতীকী গণভবন; যার নাম দেওয়া হয়েছে 'ফতেহ গণভবন'। নির্মাণ করা হয়েছে '৩৬ জুলাই এক্সপ্রেস'। এছাড়া প্রদর্শন করা হচ্ছে জুলাইয়ের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ছবি ও স্লোগান।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন