জানা যায়, পানি প্রবাহের জন্য আগে যে জায়গা ছিল, সেগুলো বাঁধ দিয়ে ভরাট করে রাখা হয়েছে। এতে করে ভারী বৃষ্টিপাত হলেই দেখা দেয় দীর্ঘ মেয়াদি জলাবদ্ধতা।
সবচেয়ে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার কবলে লক্ষ্মীপুর পৌর এলাকা। এখানে প্রয়োজনীয় ড্রেনেজ ব্যবস্থা কিংবা পানি নিষ্কাশনের পথ একেবারে নগণ্য। শহর কেন্দ্রিক ড্রেন থাকলেও শহরের বাহিরে কোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। অন্যদিকে এসব এলাকায় নিচু জমি, পুকুর ও জলাশয় প্রতিনিয়ত ভরাট হয়ে পড়েছে। যাতায়াতের পথ তৈরি করতে পানির নামার পথ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। পানি প্রবাহের পথ স্বাভাবিক না রেখে অপরিকল্পিত ভরাটের কারণে জলাবদ্ধতার কবলে পড়তে হচ্ছে বাসিন্দাদের৷ আবার কোথাও মাছ চাষের কারণে পানি প্রবাহের পথ বন্ধ রাখা হয়েছে।
অন্যদিকে পৌর এলাকার বাহিরে থাকা যে সব খাল বা নালা রয়েছে সেগুলোও ভরাট হয়ে পড়েছে। অবৈধ দখলদার ও দূষণের কবলে পড়ে খালগুলো সংকুচিত হয়ে আছে। তবে জলাবদ্ধতার পেছনে প্রশাসনের আগাম এবং কার্যকরী পদক্ষেপ না নেয়ার পাশাপাশি স্থানীয়দের খামখেয়ালীপনা ও অসচেতনতাকে দায়ী করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: খুলনায় জলাবদ্ধতায় সবজি ক্ষেত-মাছের ঘেরে ক্ষতি কয়েক কোটি টাকা
সংশ্লিষ্টরা জানান, গেল বছরের আগস্টের শেষের দিকে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ছেন লক্ষ্মীপুরবাসী। ফেনী থেকে আসা উজানের পানি এবং ভারী বৃষ্টিপাতের পানিতে ডুবে যায় জেলার বিভিন্ন অঞ্চল। চরম দুর্ভোগ ও ভোগান্তির পাশাপাশি বন্যায় ভুগিয়েছে লক্ষ্মীপুরবাসীকে। জেলা সদরের প্রধান দুটি খাল রহমতখালী ও ওয়াপদা খাল হয়ে ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পানি মেঘনা নদীতে গিয়ে পড়ে। এ ছাড়া নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ, সুবর্নচর, সদর এবং লক্ষ্মীপুর সদরের দক্ষিণাংশ, কমলনগর, রামগতি উপজেলার পানি ভুলুয়া নদী হয়ে মেঘনায় পতিত হয়।
আর ডাকাতিয়া নদী হয়ে জেলা সদরের উত্তরাংশ ও রায়পুর উপজেলার পানি মেঘনায় পড়ে। এ ছাড়া রামগঞ্জের বীরেন্দ্র খাল দিয়ে ওই উপজেলার পানি নিষ্কাশন হতো। তবে জেলার প্রধান এসব খালের অবস্থা এখন একেবারে নাজুক। দখল ও দূষণের কবলে পড়ে সবগুলো খাল এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। রায়পুরের এক সময়ের প্রবাহমান ডাকাতিয়া নদীর পৌরসভার অংশ এখন 'মরা ডাকাতিয়া' হিসেবে নাম পেয়েছে।

জেলা সদরের ওয়াপদা খালে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক থাকলেও উল্টো চিত্র রহমতখালী খালের। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থেকে পশ্চিমে লক্ষ্মীপুর সদরের মজুচৌধুরীর হাট পর্যন্ত প্রায় ৫২ কিলোমিটার অংশে শত শত মাছ শিকারের বাঁধ ও জাল রয়েছে। এ ছাড়া খালের মূল প্রস্থ ১২৮ মিটার থাকলেও এখন তা অনেকাংশে সংকুচিত হয়ে গেছে। বাজার কেন্দ্রিক বর্জ্য ফেলে খালের বিভিন্ন স্থান ভরাট করা হয়েছে। দখলদারদের কবলে পরে দুপাশে গড়ে উঠছে বিভিন্ন স্থাপনা। এতে পানি নিষ্কাশনে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
আরও পড়ুন: ফেনীতে বন্যা: পানি কমলেও চরম ভোগান্তিতে দুর্গতরা
একই অবস্থা কমলনগর ও রামগতি উপজেলার ভুলুয়া নদীরও। গেল বছরের ভয়াবহ বন্যা ও জলাবদ্ধতা ছিল ভুলুয়ার দুই পাড়ে। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েন বাসিন্দারা।
রামগঞ্জের বীরেন্দ্র খালটিও দখলে-দূষণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। অবৈধ দখলদারদের কবলে পড়ে খালটি এখন মরা খালি পরিণত হয়েছে। অবৈধ দখলদারদের কবলে পড়ে ৪৫ ফুট প্রস্থ এই খালের রামগঞ্জ পৌর এলাকায় এখন প্রস্থ এসে ঠেকেছে মাত্র ৮ থেকে ১০ ফুটে। তাছাড়া খালের ওপর সরকারিভাবে যেসব ব্রিজ এবং কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলো একেবারে নিচু এবং কম দৈর্ঘ্যের ফলে ব্রিজ-কালভার্টের নীচ দিয়ে পানি প্রবাহেও বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।
পরিবেশবিদ ও গবেষকরা বলছেন, এটা শুধু পরিবেশ নয়, বরং অর্থনীতি, ইতিহাস ও সংস্কৃতির বিপর্যয়। রামগঞ্জের মতো জায়গায় এমন একটি খাল হারিয়ে গেলে জনজীবন, কৃষি, স্বাস্থ্য সব কিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পানি নিষ্কাশন ব্যাহত হলে শহরের সড়ক ব্যবস্থাও ধসে পড়তে পারে। দ্রুত খাল পুনঃখনন, দখল উচ্ছেদ এবং আবর্জনা ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেয়া জরুরি।
আরও পড়ুন: নোয়াখালীতে বন্যা দুর্গতদের পাশে র্যাব, খাদ্যসামগ্রী ও ওষুধ বিতরণ
সচেতন নাগরিকদের মতে, খালটির দখল ও দূষণমুক্ত করতে দরকার সমন্বিত উদ্যোগ। প্রশাসন, পৌর কর্তৃপক্ষ, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় জনগণকে এক প্ল্যাটফর্মে এনে প্রকল্প ভিত্তিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।
এ দিকে খালের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং খননের দাবি জানিয়ে গেল বছর উচ্চ আদালতে রিট দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার বাসিন্দা আবদুস সাত্তার পালোয়ান। রিট দায়েরের পর রহমতখালী ও ভুলুয়া নদীতে কিছু অভিযান চালিয়ে যতসামান্য মাছ শিকারের জাল-বাঁধ অপসারণ করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পানি প্রবাহের জন্য কার্যকর ও দীর্ঘ মেয়াদি কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। চলতি শুষ্ক মৌসুমেও ভুলুয়া নদীতে শুধুমাত্র জাল অপসারণ করেই অভিযান দেখানো হয়েছে। খাল খনন বা অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
রহমতখালী খালের পৌরসভার মাদাম এলাকায় কচুরিপানা অপসারণ করা হলেও সেখানে আবারও কচুরিপানার জট বেঁধে আছে৷ কিন্তু খালের তলদেশ থাকা বর্জ্য অপসারণ এবং দখলদার উচ্ছেদ করা হয়নি। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মান্দারী ও জকসিন বাজার এলাকায় কিছু বর্জ্য অপসারণ করা হলেও বাস্তবতার দিক দিয়ে তা ছিল যৎসামান্য।
আরও পড়ুন: ঢাকাসহ ৩ বিভাগে অতিভারি বর্ষণের আশঙ্কা
তবে সদর উপজেলার বাঙ্গাখাঁ, চররুহিতা এবং কমলনগরের হাজিরহাট বাজারের জারিরদোনা খালের ওপর থাকা কিছু স্থাপনা অপসারণ করেছে প্রশাসন। কিন্তু জারিরদোনা খালে থাকা বড় বড় স্থাপনা ও ভবন উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি। খালের বর্জ্য অপসারণও করা হয়নি।
এ দিকে গেল বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) বিকেলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়৷ সেখানে ভারী বৃষ্টিপাতে জলাবদ্ধতা ও আসন্ন দুর্যোগের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হলেও এখনও অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে দৃশ্যমান কোনো কিছু চোখে পড়েনি।
লক্ষ্মীপুর পৌর প্রশাসক ও স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘জলাবদ্ধতার পেছনে মূলত নাগরিক সচেতনতার অভাব দায়ী। নাগরিকরা যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলায় ড্রেনগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া অবাধে খাল দখল, অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ ও পুকুর ভরাটের কারণেও পানি নিষ্কাশনে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার সচেতন করা হলেও তেমন সাড়া মিলছে না। বিভিন্ন স্থানে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে আমরা খালের উচ্ছেদ অভিযান এবং খাল পরিষ্কার অভিযান অব্যাহত রেখেছি।
গত শুক্রবার (১১ জুলাই) বৃষ্টিপাত না হলেও গত ৭ জুলাই সকাল থেকে শুরু হয় টানা বর্ষণ।