খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এমন হেনস্তার শিকার ব্যক্তির নাম হালিম উদ্দিন আকন্দ (৭০)। তিনি ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার কোদালিয়া গ্রামের বাসিন্দা। স্থানীয় বাসিন্দারা তাকে চেনেন হালিম ফকির হিসেবেই।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, হালিম উদ্দিন পাগল বা মানসিক বিকারগ্রস্ত নন। সংসারজীবনে তিনি পুত্র ও কন্যাসন্তানের জনক। দীর্ঘ ৩৪ বছর যাবত জট ছিল তার মাথায়। হজরত শাহজালাল (র.) ও শাহ্ পরানের (র.) ভক্ত তিনি। আগে পেশায় কৃষক থাকলেও এখন ফকিরি হালে চলাফেরা করেন। মাঝেমধ্যে কবিরাজিও করেন। গত কোরবানির ঈদের কয়েক দিন আগে উপজেলার কাশিগঞ্জ বাজারে হঠাৎ করেই একদল লোক এসে তার মাথার জট, দাঁড়ি ও চুল জোরপূর্বক কেটে দেন।
ঘটনার সময় বাধা দিতে গেলে শারীরিক নির্যাতন ও বল প্রয়োগ করা হয় বলে অভিযোগ করে বৃদ্ধ হালিম উদ্দিন বলেন, ‘সেদিন (ঘটনার দিন) সকালে বাজারে একটি দোকানে বইছিলাম। কোদালিয়ার একটা লোক আমারে হুইজ (জিজ্ঞাসা) করে, কই যাইবাম। তহন কই, লালমা (গ্রামের নাম) যাইবাম। কয়, অতো আগ্গয়া (দূরে)! তহন আমি হাঁইট্টা যাওনের লাইগ্যা পথ দেই। হিও এইবায় আয়া মোবাইল করছে হেরারে। পরে হেরা বাইর অইছে, আমারে আটকাইছে। আমি ঘরে বইয়া আছিলাম। আমারে ছেছরাইয়া বাইর কইরা এই কাম করছে।’
আরও পড়ুন: জামিনে এসে ধর্ষণের শিকার নারীকে মারধর করে চুল কেটে দিলেন আসামি!
তিনি আরও বলেন, ‘আমার তো শক্তি কোলাই না। ৮-১০ জনে ধইরাললে কী করণ। আমারে ফালায়া দিয়া হুতাইয়া চুল কাটছে। হেইবালা আমি বেহুঁশ হয়া গেছিলাম।’
সেই ঘটনার শারীরিক ও মানসিক আঘাত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি বৃদ্ধ হালিম উদ্দন। বাইরে বের হতে অস্বস্তি বোধ করেন।
তিনি বলেন, ‘হেই থাইক্কা আমি কামকাজ করতে পারি না, বাজারে আইতারি না, ঘরবৈঠক আমি। রোগী ঝাড়তে পারি না। আসকা মাইরা শইল বেহুঁশ হইয়া যায়, মাথাত পানি ঢালন লাগে (হঠাৎ হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়েন, মাথায় পানি ঢালতে হয়)।’
যারা চুল কেটে দিলেন, তাদের বিচার চান কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি কোনো কিছু কই না, যা করে মালিকে করব।’
চুল-দাঁড়ি কাটার ঘটনা যখন ঘটছিল, তখন কাশিগঞ্জ বাজারে একজন প্রত্যক্ষদর্শী হাসিব আহমেদ জুয়েল বলেন, মোট তিন-চার জন লোক মিলে জোরপূর্বক হালিম উদ্দিনের চুল কাটেন। এর মধ্যে একজন ভিডিও করার দায়িত্বে ছিলেন। আর বাকিরা হালিম উদ্দিনকে সামাল দিচ্ছিলেন। আমরা ইউটিউব ফেসবুকে দেখেছি, এই রকম পাগল, অসুস্থ লোকজনকে মানবিক লোকজন চুল দাঁড়ি কেটে দেয়, গোসল করিয়ে দেয়। কিন্তু উনি তো ওই রকম পাগল কেউ না।
হালিম উদ্দিনের বড় ছেলে জানান, মাস চারেক আগে একদিন কয়েকজন লোক আসেন হালিম উদ্দিনকে খুঁজতে। জানান তারা হালিম উদ্দিনের কাছ থেকে ঝাড়ফুঁকের চিকিৎসা করাতে এসেছেন। তিনি বলেন, মটরসাইকেল দিয়ে আসছে বিকেল টাইমে, বলে চাচা তারা আফনারে খুঁজতাছে যে তারার রোগী আছে, আফনে গিয়ে তারার রোগীটি ঝাইড়া দেওন লাগবো, বাপে কইছে বাবা আমি অহন বাড়ি আইয়া পড়ছি, আজ রোগী ঝাঁড়তাম যাইতাম না, কালকে দেমানে।’
হালিম উদ্দিনের এই কথা শুনে মোটরসাইকেলে করে আসা লোকজন বলে, তাহলে কাল একটু সকাল সকাল ঘর থেকে বের হইয়েন। এ কারণে পরদিন সকাল আটটার আগেই রোগীকে ঝাড়ফুঁক করার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয়ে যান।
আরও পড়ুন: কেটে ফেলা চুল কি বিক্রি করা যায়?
ময়মনসিংহ বাউল সমিতির সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম বলেন, ‘হালিম ভাই তরিকায়ে নক্সাবন্দিয়া ধারায় অনুরক্ত। বর্তমানে তিনি মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ। তার সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে, আমরা ময়মনসিংহ বাউল সমিতির পক্ষ থেকে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। এর সুষ্ঠু তদন্ত করে শাস্তির দাবি করছি। ময়মনসিংহের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পক্ষ থেকে আমরা শুধু ময়মনসিংহে নয়, যেন বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা পুনরাবৃত্তি না হয়, সে জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’
এ বিষয়ে তারাকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ টিপু সুলতান বলেন, বৃদ্ধ ব্যক্তিটি এলাকায় হালিম ফকির হিসেবেই পরিচিত। তিনি কবিরাজি করেন। গত ঈদুল আজহার আগে কয়েকজন কটি পড়া লোক এসে তার চুল কেটে গোসল করিয়ে নতুন কাপড় পরিয়ে দিয়ে চলে যান। ওই সব লোককে স্থানীয় কেউ চিনতে পারেনি। ভুক্তভোগীরা কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে চাইলে সে মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।