একজনের নামে একাধিক, অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠান এবং আবেদন না করেও অনেক প্রতিষ্ঠানের নাম বরাদ্দ তালিকায় দেখার মতো প্রমাণ পাওয়া গেছে। পারিবারিক কবরস্থানকে সামাজিক কবরস্থান বলেও বরাদ্দ নেয়ার রেকর্ড রয়েছে।
ময়মনসিংহ জেলা পরিষদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজস্ব বাজেটের 'জনস্বাস্থ্য' উপখাতে ৪৭টি প্রকল্পে মোট ৮৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এর মধ্যে সদর উপজেলার ভাবখালী ইউনিয়নে ৩৫ লাখ টাকার ১৭টি প্রকল্প নেয়া হয়। এসব প্রকল্পের অধিকাংশ কওমি মাদ্রাসার উন্নয়ন ও বাস্তবায়ন প্রকল্প কমিটির হাতে রয়েছে। একই ইউনিয়নে এতো বেশি বরাদ্দ নিয়ে আসায় তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে ভাবখালী ইউনিয়নে সময় সংবাদ পাঠিয়েছিল।
বরাদ্দপত্রের ৪৫ নম্বরে থাকা ‘জামিয়া হাজেরা মহিলা মাদ্রাসা’ নামে ২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেখানো হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানের পরিচালক সোলাইমান হুসাইন জানান, তিনি কোনো বরাদ্দের জন্য আবেদন করেননি।
তিনি বলেন, ‘আমার মাদ্রাসার নামে বরাদ্দ হয়েছে জেনে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম একই নাম দিয়ে বরাদ্দ নিয়ে গেছে একই ইউনিয়নের চুরখাই বাজার সংলগ্ন জামিয়া হাজেরা কওমি মহিলা মাদ্রাসা।’
আরও পড়ুন: সাবলেট ভাড়া নিতে বাসায় গেলে শিক্ষার্থীকে জিম্মি, আটক ২ তরুণী
সোলাইমানের তথ্যের সূত্র ধরে ওই মাদ্রাসায় গেলে দেখা যায়, দেয়ালে রং করে ‘জামিয়া হাজেরা কওমী মহিলা মাদ্রাসা’ লেখা থাকলেও ছাদের উপরে টানানো বোর্ডে ‘কওমী’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়েছে। অস্তিত্বহীন মাদ্রাসায় কয়েকদিন আগে সাইনবোর্ড সাঁটিয়ে টাকা তুলে নেয়া হয়েছে বলে স্থানীয়রা সরকারের অনুসন্ধানে জানান। মাদ্রাসাটির পরিচালক নজরুল ইসলামও বরাদ্দ তালিকার ৪৪ নম্বরে ‘জামিয়া হাজী শমসের আলী মহিলা মাদরাসা’ নামে ২ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছেন। প্রশ্ন করলে তিনি ক্ষিপ্ত হন এবং বলেন, ‘একই ইউনিয়নের একই নামে শুধু দুইটি না, ১০টি মাদ্রাসাও হতে পারে’; তিনি জানান, কয়েক মাস ধরে মাদ্রাসা চালু করলেও ভবন নির্মাণের সময়ই আবেদন করেছিলেন।
বরাদ্দপত্রের অন্যান্য নামগুলোর মধ্যে আছে: বরাদ্দ নম্বর ৪৩: ‘রাবেয়া বসরী মহিলা মাদ্রাসা’, ৬০: ‘সায়্যিদাতুন নিসা ফাতেমা রা. মহিলা মাদ্রাসা’, ৫৬: ‘ভাবখালী ইউনিয়নের চুরখাই মধ্যপাড়া জামিয়া ইসলামিয়া মহিলা কওমী মহিলা মাদ্রাসা’। অনুসন্ধানে আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেছে, যাদের কেউ আবেদন না করেও তাদের নামে বরাদ্দ করা হয়েছে।
রাবেয়া বসরী মহিলা মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা এনামুল হক বলেন, ‘বরাদ্দের বিষয়ে আমি জানতাম না, আইনুল ভাই আমাকে জানিয়েছে মাদ্রাসার নামে বরাদ্দ এসেছে। পরে আইনুল ভাই আমাকে জানায় খরচ বাদে ৯০ হাজার টাকা পাব।’ পরে অফিসে গিয়ে জানতে পান ২ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে; তারা নিজেই পরে আবেদন করে চেয়েছিলেন, কিন্তু এখনও টাকা পাননি।
সায়্যিদাতুন নিসা ফাতেমার পরিচালক মাওলানা আবদুল জব্বার জানিয়েছেন, তিনি জেলা পরিষদে কোনো আবেদন না করলেও এলাকার আলোচনা চলার পর জানতে পারেন তার মাদ্রাসার নামেও ২ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে; পরে তিনি জেলা পরিষদে গিয়ে আবেদন করেছেন। তিনি বলেন, ‘কোন ব্যক্তি আগে আবেদন করেছিল তা আমি জানি না।’
‘জামিয়া ইসলামিয়া মহিলা মহিলা মাদ্রাসা’র পরিচালক মুফতী এনামুল হাসান বলেন, “আইনুল ভাই এসে জানায় অনুদান এসেছে, মাদ্রাসার নাম দিবে কি না। পরে কিছু দিন আগে জানতে পারেন মাদ্রাসার নামে বরাদ্দ হয়েছে। আমাদের মাদ্রাসার নাম ‘জামিয়া ইসলামিয়া মহিলা মাদ্রাসা’। এখানে কেন 'কওমী' যুক্ত করা হয়েছে তা জানি না। আইনুলকে জিজ্ঞেস করলেও কোনো সন্তোষজনক উত্তর পাইনি। তিনি বলেছে এটি কোনো সমস্যা নয়।”
আরও পড়ুন: ছিনতাইকারীর সঙ্গে তরুণীর ধস্তাধস্তি, যা দেখা গেল সিসিটিভি ফুটেজে
আহছানুল উলূম নূরানী ও হাফিজিয়া মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা আশরাফুল আনোয়ার বলেন, ‘মাসখানেক আগে পাশের একটি মাদ্রাসীর লোকজনের মাধ্যমে খবর পাই আমাদের মাদ্রাসার নামেও বরাদ্দ হয়েছে। তখন যিনি আমাদের পক্ষ থেকে আবেদন করেছিলেন (আইনুল হক) তিনি মাদ্রাসায় এসে বলেন, যেহেতু তিনি আবেদন করেছেন, টাকা উত্তোলনের সময় তার সঙ্গে থাকতে হবে। পরে আমরা জানতে পারি বরাদ্দের এক তৃতীয়াংশ আমরা পাবো না; এতে আইনুল ভাইয়ের খরচ, অফিস খরচ ইত্যাদি বাদ থাকবে।’
ফৌজদারি ও প্রশাসনিক অনুসন্ধানে অভিযোগ উঠেছে, জালিয়াতির মাধ্যমে বরাদ্দ নেয়ার পেছনে ভূমিকা রেখেছেন স্থানীয় আইনুল হক নামে এক ব্যক্তি। তিনি নিজেই দুটি মাদ্রাসা ও একটি পারিবারিক কবরস্থানকে সামাজিক কবরস্থান দেখিয়ে মোট ৭ লাখ টাকা বরাদ্দ নিয়েছেন। কোনো পদবি না থাকলেও তিনি নিজেকে পরিচয় দেন জামায়াত কর্মী ও জুলাই যোদ্ধা।
সময় সংবাদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে জেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে তুলে একাই ভুয়া বরাদ্দ বাগিয়ে নিয়েছেন; একই গাড়িতে দুজনের ভ্রমণের ভিডিওও সময় সংবাদের হাতে এসেছে।
আইনুল হককে যোগাযোগ করে বিষয়টি জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘এখানে মাজারপূজারি একটি দল আছে যারা আমার পেছনে লেগেছে অনেকভাবেই। যার যার আবেদন, তারাই করেছে এবং উত্তোলন করছে। এখানে আমার কোনো হাত নেই।’
তিনটি বরাদ্দের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আল্লাহর রহমত ছাড়া আর কিছুই না।’ সব অভিযোগ অস্বীকার করলেও সময় সংবাদের প্রতিবেদককে ম্যানেজ করতে অনৈতিকভাবে সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করার কথা প্রতিবেদক উল্লেখ করেন।
আরও পড়ুন: আবারও বহিরাগতের হামলার শিকার নারীসহ বাকৃবির ২ শিক্ষার্থী
এলাকাবাসীর এবং সাংবাদিক অনুসন্ধানের ফলে অনিয়মের সূচনা নজরে এলে জেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কবির হোসেন সরদার বলেন, ‘আপনারা যেহেতু বরাদ্দে কিছু গরমিল পেয়েছেন, সেটি আমরা তদন্ত করবো। যদি অনিয়ম পাওয়া যায় তাহলে প্রকল্প বন্ধ করে দেয়া হবে। আমি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখবো ভুলভ্রান্তিগুলো। আর বরাদ্দ আমি তো একা দেই না, দেখা যায় প্রশাসকই বেশি বরাদ্দ দিয়ে থাকেন।’
ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের প্রশাসক ও অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার তাহমিনা আক্তার বলেন, ‘কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে লিখিত অভিযোগও পাওয়া গেছে। তদন্ত করে দেখা হবে। অনিয়মের সঙ্গে অফিসের কারও সম্পৃক্ততা থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
ময়মনসিংহ মহানগর সুজনের সহসভাপতি তৌহিদুজ্জামান ছোটন বলেন, ‘মাদ্রাসার নামে বরাদ্দের এমন নয়-ছয় অত্যন্ত নিন্দনীয়। আমরা চাই এই অনিয়মের পেছনে জড়িতদের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা হয়।’
]]>