সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কির নেতৃত্বে নেপালে একটি নতুন সরকার গঠিত হয়েছে এবং তিন সদস্যের একটি মন্ত্রিসভাও গঠন করা হয়েছে। তবে কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন তা এখনও অজানা। জানা গেছে, সরকার এই ভূমিকার জন্য কয়েকজন সাবেক সচিব এবং রাষ্ট্রদূতের সাথে যোগাযোগ করছে। তবে এখনও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যিনিই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করুক না কেন, তাকে অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।
২০২৬ সালের মার্চে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং সাম্প্রতিক বিক্ষোভের সময় ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত শত শত অবকাঠামো পুনর্নির্মাণের পাশাপাশি, নতুন সরকারকে আরও বেশ কয়েকটি বাহ্যিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নিকটতম প্রতিবেশী ভারত ও চীনের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, যুক্তরাজ্য, জাপান এবং কোরিয়ার মতো বৃহৎ ও মধ্যম শক্তির সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে নেপালের জন্য।
আরও পড়ুন: নেপালের নতুন প্রধানমন্ত্রীরও পদত্যাগ চায় জেন-জি, ফের বিক্ষোভ
নেপালের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনাকে প্রভাবিত করে এমন ভূ-রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন সংগ্রহ করাও নতুন সরকার এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে।
নতুন সরকার গঠন এবং কার্কি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করার সাথে সাথেই তিনি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা এবং একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরির সরকারের লক্ষ্য পূরণের জন্য ব্যাপক সমর্থন এবং শুভেচ্ছাবার্তা পান। কিন্তু, অতীতে কীভাবে ভুল হয়েছে এবং দেশ কীভাবে বর্তমান কঠিন পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে তা-ও উল্লেখ করেছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সাবেক উপদেষ্টা শঙ্কর দাস বৈরাগীর মতে, উদীয়মান ভূ-রাজনৈতিক প্রবণতাসহ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে ব্যর্থতা একটি দেশের পররাষ্ট্র নীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। প্রধান পররাষ্ট্র নীতিগত ভুলগুলোকে একজন পাইলটের মারাত্মক ভুলের সাথে তুলনা করেছেন তিনি।
তিনি বলেন,
বিদেশ নীতি পরিচালনার বিষয়টি দ্বিমুখী। আমাদের বুঝতে হবে অন্যরা আমাদের কীভাবে দেখে। আমরা বহিরাগত শক্তি এবং বন্ধুদের আচরণ মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের মিশনগুলোতে স্বাগতিক দেশগুলোর পরিবর্তনশীল গতিশীলতা সম্পর্কে কৌশল এবং তথ্য থাকা উচিত। আমাদের বিদেশ নীতি অন্যদের নীতি এবং মনোভাব দিয়ে নির্ধারিত হতে শুরু করেছে, যা বর্তমান বিশৃঙ্খলার জন্য আংশিকভাবে দায়ী।
অনেক পররাষ্ট্র নীতি বিশেষজ্ঞ মনে করেন, নেপালের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের পেছনে ভূ-রাজনৈতিক কারণগুলোও ভূমিকা রাখতে পারে। তারা বলছেন, নতুন সরকারকে এই অন্তর্নিহিত বিষয়গুলোও সমাধান করতে হবে।
আরও পড়ুন: সোশ্যাল মিডিয়ায় দাবি /নেপালে লুটের জিনিস ফেরত, একজন এলেন খাবারসহ রাইস কুকার নিয়ে!
ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর নেপাল অ্যান্ড সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ (সিএনএএস)-এর নির্বাহী পরিচালক মৃগেন্দ্র বাহাদুর কার্কি বলেছেন,
নতুন প্রধানমন্ত্রী যেভাবে দালাই লামাসহ সবার কাছ থেকে অভিনন্দন বার্তা পেয়েছেন, তাতে জনসাধারণের মাঝে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন,
এই ভূ-রাজনৈতিক অস্পষ্টতা দূর করা নতুন সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। চীন এই পরিবর্তনগুলো কীভাবে উপলব্ধি করে; ভারত, চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের সম্পর্কের ভারসাম্য কীভাবে বজায় থাকে এবং কীভাবে আমরা এটি নিরাপদে পরিচালনা করি তা একটি প্রধান কাজ। পুনর্গঠনের জন্য আমাদের বিশাল বিদেশি সহায়তার প্রয়োজন। তবে শুধুমাত্র ভারত বা চীনের কাছ থেকে সমর্থন চাওয়া আমাদের পররাষ্ট্র নীতিকে ব্যাহত করতে পারে।
এদিকে, নেপালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড পর্যটনের ওপর আস্থা পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দিচ্ছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। করোনা মহামারির পর নেপালের পর্যটন খাত কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও, সাম্প্রতিক বিক্ষোভের কারণে এটি প্রভাবিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কাঠমান্ডু-ভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ (সিএসএএস)-এর পরিচালক নিশ্চল এন পান্ডে বলেন, ‘নভেম্বর-ডিসেম্বর হলো পর্যটন মৌসুমের সর্বোচ্চ সময়। আমাদের অবশ্যই আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে যে নেপাল আবারও উঠে দাঁড়াচ্ছে।’
আর নেপালকে পুনর্গঠনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জন অপরিহার্য বলেই মত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিডি ভাট্টার।
সিএনএএসের কার্কিও বিশ্বাস করেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ওলির ভূ-রাজনৈতিক দুঃসাহসিকতা আজকের পরিস্থিতির জন্য দায়ী। জাপানের ‘শত্রু’ হিসেবে বিবেচিত চীনে একটি সামরিক কুচকাওয়াজে ওলির অংশ নেয়ার সিদ্ধান্তটি ‘অযৌক্তিক’ ছিল, কারণ জাপান নেপালের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন অংশীদার।
আরও পড়ুন: নেপালের অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী /‘বিক্ষোভের নামে যা ঘটেছে, মনে হচ্ছে সব পরিকল্পিত’
বিশ্লেষক সিডি ভাট্টা বলেছেন,
আমরা যদি অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সাবধানতার সাথে পরিচালনা না করি, তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
তার ভাষ্য, ‘যেহেতু এই সরকার বিক্ষোভ থেকে এসেছে, তাই তাদের অবশ্যই প্রতিবেশী এবং অন্যান্য দেশের সাথে সুসম্পর্ক নিশ্চিত করতে হবে। বাহ্যিক চ্যালেঞ্জগুলো অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গতিশীলতার ওপর নির্ভর করে। এছাড়াও, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে, বৈদেশিক নীতি গঠনে এর ভূমিকা সীমিত থাকবে।’
সূত্র: কাঠমান্ডু পোস্ট
]]>