জানা গেছে, মাসখানেক আগে জিয়া শেখ চলতি আমন মৌসুমে নিজ বাড়ির পেছনের মাঠে দুই বিঘা ও সামনের মাঠে আরও পাঁচ বিঘা জমিতে স্বর্ণা জাতের ধানের চারা রোপণ করেন। তবে পানি জমে থাকায় চারা পচে গেছে।
তার অভিযোগ, প্রভাবশালীরা গত ২০ বছর ধরে ড্রেনেজ খাল দখল করে ঘরবাড়ি নির্মাণ ও মাছ চাষ করে আসছেন। এতেও আগে অল্প অল্প করে পানি বের হতো। কিন্তু এবার এক আইনজীবী পাকা বাড়ি নির্মাণের জন্য খাল পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে পানি আটকে গিয়ে ধান ডুবে গেছে, চারা পচে নষ্ট হচ্ছে।
তিনি জানান, চারা, জমি চাষ ও সারসহ বিঘাপ্রতি ৩ হাজার টাকা হিসেবে প্রায় ২১ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। পানি নিষ্কাশন স্বাভাবিক থাকলে সাত বিঘা জমিতে অন্তত ৮০-১০০ মণ ধান পাওয়া যেত।
ইউনিয়নের মট মালিয়াট গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ছয় বিঘা জমির ধান ডুবে সাদা হয়ে গেছে। ফসল ডুবে শ্যাষ! আপনারা একটু পানি বের করে দেন।’ তার ভাষ্য, খাল ভরাট করে উকিল সাহেব পাকা বাড়ি নির্মাণ করায় এবার পানি বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এতে কয়েক হাজার বিঘা জমির ফসল পানিতে ডুবে গেছে।
স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সদকী ইউনিয়নের তরুণমোড়-তারাপুর সড়কের গড়েরমাঠ এলাকায় প্রায় আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে একটি সেতু নির্মাণ করে এলজিইডি। সেখান থেকে বানিয়াকান্দি, মালিয়াট, মট মালিয়াট, করাতকান্দি হয়ে মোড়াগাছা পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার ড্রেনেজ খাল রয়েছে। এই খালের দুই পাশে কয়েক হাজার বিঘা কৃষিজমি রয়েছে, যেখানে বর্তমানে আমন ধানের চাষ হয়েছে। মূলত এই খাল দিয়েই অতিরিক্ত পানি গড়াই নদীতে প্রবাহিত হওয়ার কথা।
কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতায় গত ১০-১২ বছর ধরে গড়েরমাঠ সেতুর মুখে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছেন জগন্নাথপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক পলাশ হোসেন সুজন। পাশাপাশি অন্তত ২০ বছর ধরে খালের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য কাঁচা-পাকা ঘরবাড়ি ও ছোট ছোট পাইপ কালভার্ট নির্মাণ করেছেন প্রভাবশালীরা, যা পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে। চলতি বছর মট মালিয়াট এলাকায় খাল ভরাট করে অবসরপ্রাপ্ত আইনজীবী মো. ইউসুফ আলী পাকা বাড়ি নির্মাণ করেছেন, ফলে পানি চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় এবং প্রায় আড়াই হাজার বিঘা আমন ধানসহ কৃষিজমি প্লাবিত হয়। কৃষকরা দ্রুত পানি অপসারণের দাবি জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন: নৈশপ্রহরীর হাত-পা বেঁধে ডাকাতি, গ্রেফতার ২
সোমবার (২৮ জুলাই) দুপুরে গুড়িগুড়ি বৃষ্টির মধ্যে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, গড়েরমাঠ সেতুর মুখে মাটি ও জাল দিয়ে বাঁধ দেয়া হয়েছে। খালে বড় বড় কচুরিপানা জন্মেছে, কয়েকশ’ মিটার পর পর রয়েছে ছোট-বড় পাইপ ও কালভার্ট। খাল ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে কাঁচা ও পাকা বাড়ি। খালে পানি থাকলেও প্রবাহ নেই। দুই পাশে জমিতে আমন ধানের চারা ঝিমিয়ে পড়েছে, ভেসে গেছে অনেক মাছের পুকুর।
মালিয়াট গ্রামের প্রবীণ কৃষক মনছের আলী বলেন, ‘আগে পূর্ব ও দক্ষিণ পাশ দিয়ে খালের পানি নদীতে চলে যেত। এখন ইউসুফ উকিল পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছেন। আমার তিন বিঘাসহ অন্তত দুই-তিন হাজার বিঘা জমির ধান ডুবে গেছে।’
মট মালিয়াট মাঠে দুই বিঘা জমিতে চারা রোপণ করা রিন্টু শেখ বলেন, ‘খাল দখল করে কেউ মাছ চাষ করছে, কেউ বাড়ি বানাচ্ছে। এতে পানি বের হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে, জমির ফসল ডুবে গেছে।’ তিনি জানান, এতে তার প্রায় ১০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে।
খোর্দ তারাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আতিয়ার রহমান বলেন, ‘গড়েরমাঠ এলাকায় সরকার আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে সেতু নির্মাণ করেছে। কিন্তু স্থানীয়রা বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করায় জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। বর্ষায় বিদ্যালয়ের খেলার মাঠসহ হাজার হাজার বিঘা জমি পানিতে তলিয়ে যায়।’
আরও পড়ুন: পাট জাগ দিতে গিয়ে নদীতে ডুবে বাবা-ছেলের মৃত্যু
অভিযুক্ত অবসরপ্রাপ্ত আইনজীবী ইউসুফ আলী বলেন, ‘ব্যক্তিগত জমিতে বাড়ি নির্মাণ করেছি। সরকার চাইলে মেপে সরকারি জমিতে খাল খনন করুক।’
মাছচাষী পলাশ হোসেন সুজন বলেন, ‘গড়েরমাঠে সেতুর প্রয়োজন নেই। আমি ব্যক্তিগত জমিতে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছি। এতে পানি প্রবাহে কোনো সমস্যা নেই।’
সদকী ইউনিয়নে ভারি বৃষ্টিতে প্রায় ৩৪০ হেক্টর আমন ধান প্লাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. রাইসুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘পানি অপসারণের বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলাম বলেন, ‘ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। খুব শিগগিরই জমি পরিমাপ করে খাল খননের উদ্যোগ নেয়া হবে।’
]]>