চীনে এবারের এসসিও সম্মেলন কেন এত গুরুত্বপূর্ণ

৪ সপ্তাহ আগে
‘‘যেসব মানুষ অভিন্ন স্বপ্ন লালন করেন, কোনো পাহাড় কিংবা মহাসাগরও তাদের মধ্যে কোনো বাঁধা তৈরি করতে পারে না,’’ ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কাজাখস্তানের রাজধানী আস্তানায় আয়োজিত সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও)-এর শীর্ষ সম্মলনে কথাটি বলেছিলেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।

সেই সময়ে প্রাচীন এই চীনা প্রবাদটি শি জিনপিংয়ের মুখে কিছুটা অতিরঞ্জিত ও বাস্তবতাবিবর্জিতই মনে হয়েছিল। কারণ এসসিও’র গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সংসদ অধিবেশনের কারণ দেখিয়ে সেই সম্মেলনে যোগদান করেননি। যা প্রধানত বেইজিং ও মস্কো নেতৃত্বাধীন সংগঠনটির জন্য বড় ধাক্কা ছিল।

 

কিন্তু ঠিক এক বছর পর ভূরাজনৈতিক দৃশ্যপট বেশ ভিন্নভাবে ধরা দিচ্ছে। রোববার (৩১ আগস্ট) এসসিও’র বার্ষিক সম্মেলন আয়োজন করতে যাচ্ছে চীন। এবারের সম্মেলেনে আঞ্চলিক নেতাদের উপস্থিতি আরও বেশি জাঁকজমক হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

 

২০১৮ সালের পর প্রথম চীন সফরে যাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি। ২০২০ সালে দুই দেশের সেনার মধ্যে একটা বড় ধরনের সংঘাতের পর তলানিতে ঠেকা সম্পর্ক ফের স্বাভাবিক হতে শুরু হয়েছে এমন সময়ে তার এই সফরকে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।

 

আরও পড়ুন: জিনপিংয়ের ‘গোপন’ চিঠির মাধ্যমে সম্পর্ক উন্নতির পথে ভারত-চীন!

 

বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ নয়াদিল্লিকে বেইজিং ও ইউরেশিয়া অঞ্চলের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দেশের সঙ্গে আরও শক্তিশালী অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

 

যখন ট্রাম্পের অতিরিক্ত শুল্ক ও হুমকির কারণে বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চল একটা সংকট মোকাবিলা করছে, তখন বিশ্লেষকরা প্রত্যাশা করছেন, এসসিও সম্মেলন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে তার নিজের দেশকে একটি বড় শক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে সাহায্য করবে। যার মাধ্যমে তিনি পশ্চিমাদের বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রকে পাশ কাটিয়ে গ্লোবাল সাউথকে সঙ্গে নিয়ে একটা ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ গড়তে সক্ষম হবেন।

 

গত সপ্তাহে চীনের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিউ বিনের কণ্ঠে সেই প্রত্যয়ই ধ্বনিত হয়েছে। বেইজিংয়ে একটি সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘‘চলতি বছর চীনে আয়োজিত এসসিও সম্মেলনটি হবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’’

 

এসসিও কোথায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে, কারা অংশ নিচ্ছেন?

 

চলতি বছরের সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে চীনের বোহাই সাগরের তীরে অবস্থিত উত্তরাঞ্চলীয় শহর তিয়ানজিনে। আগামী ৩১ আগস্ট শুরু হবে দুদিনব্যাপী এই সম্মেলন। সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিউ বিন বলেন, এই সম্মেলনে ২০টির বেশি দেশের নেতা এবং ১০টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান যোগদান করবেন।

 

এসসিও’র সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ, বেলারুশ প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো, কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট কাশিম জোমার্ট তোকায়েভ, উজবেকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শাভকাত মিরজিয়োয়েভ, কিরিগিস্তানের প্রেসিডেন্ট সাদির জাপারভ এবং তাজিকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইমোমালি রহমান যোগ দেবেন।

 

এছাড়া তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাবোয়ো সুবিয়ান্তো, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম এবং মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জুসহ আরও বেশ কয়েকজন নেতা যোগ দেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া এই সম্মেলনে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতারেস এবং আসিয়ানের মহাসচিব কাও কিম হোর্ন যোগে দেবেন।

 

এসসিও কতটা গুরুত্বপূণ?

 

এসসিও’র যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৯৬ সালে একটি নিরাপত্তা জোট হিসেবে। তখন এর নাম ছিল সাংহাই ফাইভ। মূলত শীতল যুদ্ধের অবসান ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তাদের সীমান্ত বিরোধ মেটানোর জন্য চীন, রাশিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান ও তাজিকিস্তানকে নিয়ে এটি গঠিত হয়।

 

কিন্তু ২০০১ সালের জুনে এই জোট রূপ নেয় সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন তথা এসসিও হিসেবে। এই সময় উজবেকিস্তানও যোগ দেয়। এর সদর দফতর স্থাপন করা হয় বেইজিংয়ে। ২০১৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান এর পূর্ণ সদস্য লাভ করে। এরপর ২০২৩ সালে ইরান এবং ২০২৪ সালে বেলারুশও পূর্ণ সদস্যপদ পায়।

 

এছাড়া সংস্থার ১৪টি গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ সহযোগী দেশ রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, মিশর, তুরস্ক, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও কম্বোডিয়া। এসসিওর সদস্য রাষ্ট্রগুলো বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪৩ শতাংশ এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির ২৩ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় এক-চতুর্থাংশ নিয়ন্ত্রণ করে।

 

এবারের সম্মেলন যে কারণে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক?

 

চলতি বছরের সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে এক অস্থির বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে। যার মধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধ চলছে, গাজায় ও পশ্চিম তীরে ইসরাইলের গণহত্যা অব্যাহত রয়েছে, দক্ষিণ এশিয়া ও এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিরাপত্তাজনিত উত্তেজনা এবং ট্রাম্পের বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধ রয়েছে।

 

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্ব যখন স্পষ্টতই গভীর অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে, তখন বিশেষ করে চীন বা রাশিয়া এ যুক্তি তুলতে পারে যে বিশ্ব এখন একাধিক সংকটের যুগে প্রবেশ করছে এবং সামনে এগোনোর পথ হিসেবে জোট নিরাপত্তা ধারণাটিই তারা তুলে ধরবে।

 

যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কী বার্তা আছে?

 

ট্রাম্প গ্লোবাল সাউথ থেকে আসা সংগঠনগুলোর ব্যাপক সমালোচক ছিলেন। অতীতে তিনি ব্রিকসকে দুর্বল করে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে লক্ষ্যভিত্তিক শুল্ক আরোপ এবং এই জোটকে ‘অ্যান্টি-আমেরিকান’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।

 

হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও জনপ্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আলেজান্দ্রো রেয়েস বলেন, এসসিও সম্মেলনকে যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করবে এবং এটি এ বছর পরে ভারতের আয়োজনে অনুষ্ঠিতব্য কোয়াড সম্মেলনের বিষয়টিও ঠিক করে দিতে পারে।

 

কোয়াড বা কোয়াড্রিল্যাটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ ২০০৭ সালে ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ উদ্যোগে গঠিত হয়েছিল। মূলত এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় এটি গঠিত হয়। গত পঁচিশ বছরে বেইজিংয়ের উত্থান নিয়ে যৌথ উদ্বেগের কারণে ভারত যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে

 

আরও পড়ুন: চীনে মোদিকে লাল গালিচায় উষ্ণ অভ্যর্থনা

 

কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানির জন্য ওয়াশিংটন যখন নয়াদিল্লির ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, তখন বিশ্লেষকরা আশা করছেন যুক্তরাষ্ট্র সোমবার তিয়ানজিনে মোদি ও শি এর বৈঠকটিকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। রেয়েস বলেন, ‘বর্তমানে ভারতের উপর মার্কিন শুল্ক আরোপের মধ্যে আসন্ন কোয়াড শীর্ষ সম্মেলনকে মোদি কীভাবে সামাল দেন সেটিই এখন দেখার বিষয়।’
 

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন