চা শিল্পাঞ্চলের জন্য প্রথম নির্মিত এ ডাকঘরটিতে দুর্লভ ওয়াল লেটার, মাটির নিচে পোঁতা লোহার সিন্ধুকসহ নানা ব্যবহার্য জিনিসপত্র ব্রিটিশ পুরনো অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে। আর এসব পুরানো জিনিসপত্র দেখে পর্যটকেরা মুগ্ধ হচ্ছেন।
ভারত বর্ষসহ এ অঞ্চলে,অনেক বছরের রাজত্ব ছিল ব্রিটিশদের। তাদের এ রাজত্বকালে নিজ প্রয়োজন এবং ব্যবসা বাণিজ্য প্রসারের স্বার্থে তারা দৃষ্টিনন্দন বিভিন্ন অফিস আদালত ভবন নির্মাণ করে গেছেন। দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় ঐতিহাসিক এসব দালানঘর কোনটি এখনও টিকে থাকলেও আবার কোনটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে । তবে দীর্ঘ একশো এক বছর ধরে ব্রিটিশ অস্তিত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলায় চা শিল্পাঞ্চলের জন্যে ব্রিটিশদের নির্মিত প্রথম কালিঘাট ডাকঘরটি।
সবুজ চায়ের বুকে টুকটুকে লাল রঙের আকর্ষণীয় দুচালা টিনসেড এ ডাকঘরটি শুধু যে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তা কিন্তু নয়। এ ডাকঘরে সেই সময়ে ব্রিটিশদের ব্যবহার্য বিরল ওয়াল লেটার বক্স, মাটির নিচে রাখা লোহার সিন্দুক , দুটি কাঠের সিন্দুক , চেয়ার টেবিল ও চিঠিপত্রের ওজন মাপার লোহার তৈরি দাঁড়িপাল্লাসহ বেশকিছু দুর্লভ জিনিসপত্র। যা আজও অতিযত্নে, আগলে রাখা হয়েছে। আগেকার মতো চিঠিপত্র লেনদেন আর ব্যস্ততার কোলাহল না থাকলেও-বাগানে বাগানে চিঠিপত্র বিলি এখনও কমবেশি হয়ে আসছে। প্রতিদিন কম করে হলেও ১০ থেকে ১২ টি চিঠি ডাকপিয়ন বিলি করছে।
আরও পড়ুন: যশোর প্রধান ডাকঘরের টাকা আত্মসাত মামলার চার্জশিট
চা বাগান এলাকার প্রবীণদের দেয়া তথ্যে জানা যায়, ব্রিটিশ চা প্ল্যান্টাররা মূলত এখানে তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করতেন। সেই সঙ্গে বসবাস ছিল বিশাল একটি চা জনগোষ্ঠীর। যাদের জন্মস্থান ছিল সুদূর ভারতে। কাজেই ব্রিটিশ আর চা জনগোষ্ঠীর আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজন মেটাতে এ ডাকঘরটি ব্রিটিশরা তৈরি করেন। এখন পর্যন্ত এ ডাকঘরটিকে সিলেট বিভাগের চা-শিল্পাঞ্চলের প্রথম ও প্রাচীনতম ডাকঘর হিসেবে পরিচিত।
দেশের প্রতিষ্ঠিত চা কোম্পানি জেমস ফিনলের কালিঘাট চা বাগান। এ বাগানের ২৭ শতক জমিতে প্রায় আড়াই শতক জায়গা নিয়ে এ ডাকঘরটি দাঁড়িয়ে আছে। দুচালা টিনসেড বিশিষ্ট এ ঘরে দুটি রুমের একটিতে অফিস কার্যক্রম এবং অপরটিতে সাব পোস্ট মাস্টারের বাসস্থান।
জানা গেছে, ডাকঘর কার্যক্রমের শুরুতে বিহারি নামের একজন পোস্ট মাস্টার ছিলেন। তখন তিনি তার পরিবার নিয়েই বসবাস করতেন। এভাবে এ নিয়ম দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে বাস্তবায়িত ছিল। সবশেষ ২০১১ সাল পর্যন্ত নারায়ন চন্দ্র পাত্র নামের একজন পোস্ট মাস্টার এখানে থাকতেন। তবে প্রাচীনতম এ ঘরটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ায়- এখন আর কেউ থাকছে না। বর্তমান কালিঘাট ডাকঘরটির দায়িত্বে রয়েছেন, সাব পোস্ট মাস্টার তুষার কান্তি দত্ত পুরকায়স্থ আর ডাকপিয়ন স্বপন তাঁতী।
মূলত এ দু'জনই পুরোনো এ ডাকঘরটিকে আগলে রেখে লোকজনকে সেবা দিচ্ছেন। নিবেদিত প্রাণ এ দুজনের মধ্যে সাব পোস্ট মাস্টার তুষার কান্তি দত্ত পুরকায়স্থ জানালেন, সেইসব পুরানো স্মৃতি কথা। তিনি বললেন, এ ডাকঘরটির আগের মতো জৌলুস না থাকলেও এখনও চিঠিপত্র আসে। আর সেসব কাজ তিনি করে যাচ্ছেন।
আরও পড়ুন: ডাকঘরে মিলবে ৩২৫ ধরনের ই-গভর্নমেন্ট সেবা!
আর ডাকপিয়ন স্বপন তাঁতী জানালেন, প্রতিদিন সে বাগানের কোনো কোনো স্থানে তাকে সাইকেলে চিঠি বিলি করতে যেতে হয়। এতে তার ভালোই লাগে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অফিস করতে হয়। কালিঘাট চা বাগানের সন্তান পরিতোষ কুমার তাঁতী। তিনি জানালেন, এখানেই তার জন্ম। কালিঘাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি জন্মের পর থেকে এ পোস্ট অফিসটি দেখে আসছেন। তার পরিবার ও তিনি নিজেও এ পোস্ট অফিসের মাধ্যমে আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে চিঠিপত্র দেয়া নেয়া করছেন। তখন খুবই জমজমাট ছিল পোস্ট অফিস টি। তার দাবি, এটিকে সংরক্ষণের পাশাপাশি আধুনিকায়ন করার।
কালিঘাট চা বাগানের তথ্যমতে, ১৯২৩ সালের দিকে এ ডাকঘরটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।