মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) এক্স-এ এক পোস্টে রয়টার্স থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেন ভ্যালেরি। তিনি বলেন, ‘গাজায় ২৪৫ জন সাংবাদিকের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডকে ন্যায্যতা দেয়া এবং হত্যাকারীর হাত মজবুত করার ক্ষেত্রে রয়টার্সের ভূমিকার কারণে আমার পক্ষে তাদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে উঠেছে।’ ফেসবুকে নিজের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টেও পোস্টটি শেয়ার করেছেন। রয়টার্স থেকে তার এই পদত্যাগের ঘোষণা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
ভ্যালেরি জানিয়েছেন, তিনি সংবাদ সংস্থাটিতে আট বছর ধরে ‘স্ট্রিংগার’ হিসেবে কাজ করেছেন। স্ট্রিংগার হলেন একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার বা ভিডিওগ্রাফার যিনি কোনো সংবাদ সংস্থাকে নিয়মিত প্রতিবেদন, ছবি বা ভিডিও সরবরাহ করেন। কিন্তু প্রতিটি কাজের জন্য আলাদাভাবে পারিশ্রমিক পান। তার তোলা ফটো নিউইয়র্ক টাইমস, আল জাজিরা ও বিশ্বের অন্যান্য প্রথম সারির গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রকাশিত হয়।
সম্প্রতি ইসরাইলি হামলায় আনাস আল শরিফসহ আল জাজিরার কয়েকজন সাংবাদিক নিহত হওয়ার পর তাদের নিয়ে রয়টার্সের বিতর্কিত প্রতিবেদনের তীব্র সমালোচনা করেছেন ভ্যালেরি। তিনি বলেছেন, গত ১০ আগস্ট ইসরাইল যখন গাজা সিটিতে আনাস আল শরিফসহ আল জাজিরার একটি সাংবাদিক দলকে হত্যা করে, তখন রয়টার্স ইসরাইলের ‘সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন’ এই দাবি প্রকাশ করে যে, আনাস হামাসের সদস্য ছিলেন।
আনাসকে নিয়ে রয়টার্সের প্রতিবেদনকে গাজায় ইসরাইলের চালানো অগণিত মিথ্যা প্রচারণার অন্যতম উল্লেখ করে তিনি লেখেন, রয়টার্সের মতো গণমাধ্যমগুলো বিনা প্রশ্নে এমন মিথ্যাকে বারবার দায়িত্ব নিয়ে প্রচার করছে।
এভাবে গাজার সাংবাদিকদের প্রতি সম্মান জানানোর কারণে বিপদের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ভ্যালেরি। বলেছেন, ‘গাজার সাংবাদিকদের সাহস এবং ত্যাগকে সম্মান জানানোর অর্থ কী তা আমি জানি না, যারা সর্বকালের সেরা এবং সাহসী। তবে ভবিষ্যতে আমি আমার যা কিছু অবদান রাখতে পারি তা সেই সাহসী হৃদয়গুলোর কথা মনে রেখেই দায়িত্ব পালন করব। আমি ফিলিস্তিনে আমার সহকর্মীদের কাছে অন্তত এতটুকু ঋণী থাকতে চাই।’
ভ্যালেরি আরও বলেন যে, ‘ইসরাইলের মিথ্যা প্রচারণাকে চিরস্থায়ীভাবে টিকিয়ে রাখার’ ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থাটির অভিলাস তাদের নিজস্ব সাংবাদিকদেরও ইসরাইলের গণহত্যা থেকে রেহাই দেয়নি। এর মাধ্যমে তিনি মূলত রয়টার্সের ক্যামেরাম্যান হোসাম আল মাসরিসহ আরও পাঁচ সাংবাদিক হত্যার কথা তুলেছেন।
আরও পড়ুন: জিম্মি মুক্তি ও গাজা যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভে উত্তাল ইসরাইল
গত সোমবার (২৫ আগস্ট) সকালে ইসরাইলের টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হন হোসাম আল মাসরিসহ ছয় সাংবাদিক। গাজার আল নাসের হাসপাতালে হামলা চালানো হলে তারা নিহত হন। ভ্যালেরি বলেন, ‘ডাবল ট্যাপ’ হামলা চালানো হয়েছে। প্রথমে ইসরাইল একটি স্কুল বা হাসপাতালের মতো বেসামরিক স্থাপনায় বোমা ফেলে; তারপর যখন চিকিৎসাকর্মী, উদ্ধারকারী দল ও সাংবাদিকেরা ঘটনাস্থলে পৌঁছান, তখন আবারও হামলা চালায়।’
গাজার এসব ঘটনা ঘটার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির জন্য পশ্চিমা গণমাধ্যমকে সরাসরি দায়ী করেছেন এই আলোকচিত্র সাংবাদিক। নিজের লেখায় ড্রপ সাইট নিউজের জেরেমি স্কাহিলকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন, ‘নিউইয়র্ক টাইমস থেকে শুরু করে ওয়াশিংটন পোস্ট, এপি থেকে রয়টার্স সবাই ইসরাইলের মিথ্যা প্রচারণার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, যুদ্ধাপরাধকে সাফসুতরো করেছে, ভুক্তভোগীদেরকে অমানুষ হিসেবে উপস্থাপন করেছে, এমনকি নিজেদের সহকর্মীদেরও পরিত্যাগ করেছে এবং সত্য ও নৈতিক সাংবাদিকতার প্রতিশ্রুতি ত্যাগ করেছে।’
পশ্চিমা গণমাধ্যমের সমালোচনা করে ভ্যালেরি আরও বলেন, সাংবাদিকতার মৌলিক নীতি পরিত্যাগ করে এবং ইসরাইলের মিথ্যা প্রচারণাকে কোনো যাচাই ছাড়াই বারবার প্রচার করে পশ্চিমা মিডিয়া এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যেখানে মাত্র দুই বছরের মধ্যে এক ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কোরিয়া যুদ্ধ, ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, যুগোস্লাভিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ মিলিয়েও যত সাংবাদিক নিহত হয়নি, তার থেকেও বেশি সাংবাদিক হত্যা করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: গাজা যুদ্ধের অবসান চায় বেশিরভাগ ইসরাইলি সেনা: জরিপ
আল জাজিরার সাংবাদিক আনাস আল শরিফ হত্যা নিয়ে ভ্যালেরি বলেছেন, ‘আনাস আল শরিফের কাজ রয়টার্সের জন্য পুলিৎজার পুরস্কার এনে দিলেও যখন ইসরাইলি দখলদার বাহিনী তাকে তথাকথিত ‘হিট লিস্টে’ তুলে ধরেছিল—যেখানে সাংবাদিকদের হামাস ও ইসলামিক জিহাদের সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল- তখনও রয়টার্স তার পাশে দাঁড়ায়নি।’
আনাস আল শরিফ তাকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের কাছে আহ্বান জানিয়েছিলেন। আনাসকে যে ইসরাইল হত্যা করতে চায়, ইসরাইলি সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র এক ভিডিওতে তা আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিল। ভ্যালেরির অভিযোগ, ‘তখনও রয়টার্স তার (আনাসের) পাশে দাঁড়ায়নি। এমনকি কয়েক সপ্তাহ পরে যখন তাকে অনুসরণ করে হত্যা করা হলো, তখনো তারা তার মৃত্যু নিয়ে সৎভাবে প্রতিবেদন করেনি।’
ফেসবুক পোস্টের সঙ্গে রয়টার্সের দেয়া নিজের প্রেস কার্ড (আইডি কার্ড) ভেঙে দুই টুকরো করে তার ছবি সংযুক্ত করে দিয়েছেন ভ্যালেরি। পোস্টের শেষাংশে তিনি লিখেছেন, ‘গত আট বছরে রয়টার্সে আমার কাজকে আমি মূল্যবান মনে করেছি। কিন্তু এখন এই প্রেস কার্ড গলায় ঝোলানো আমার কাছে ভীষণ লজ্জা ও বেদনার বিষয় ছাড়া আর কিছু নয়। গাজার সাংবাদিকদের সাহস ও আত্মত্যাগকে সম্মান জানানো শুরু করার মানে কী, আমি জানি না—তারা ইতিহাসের সবচেয়ে সাহসী ও শ্রেষ্ঠ সাংবাদিক। তবে এখান থেকে আমি আমার সামর্থ্যের প্রতিটি অবদান সেই চিন্তা সামনে রেখে পরিচালিত করব।’