গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর যে ৬ চ্যালেঞ্জের মুখে নেতানিয়াহু

৪ সপ্তাহ আগে
গত দুই বছর ধরে ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইল নজিরবিহীন মৃত্যু ও সীমাহীন মানবিক দুর্ভোগ ঘটিয়েছে। এগুলো যে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য স্বস্তি এনেছে, তা বলা যায় না। অন্তত কিছু পর্যবেক্ষক এমনটাই মনে করেন।

সমালোচকরা ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন। তারা বলছেন, নেতানিয়াহুর সামনে যেসব রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছিল, সেখান থেকে মানুষের চোখ সরাতে গাজা যুদ্ধকে তিনি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন তিনি। তবে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরও তার সেসব চ্যালেঞ্জ বা সংকট দূর হয়নি।

 

এমনকি যে যুদ্ধবিরতিকে নেতানিয়াহু নিজের জয় হিসেবে দেখানোর জন্য মরিয়া, সেটাকে সাবেক ইসরাইলি রাষ্ট্রদূত এলন পিনকাসসহ অনেকেই ‘আরোপিত’ বলে মনে করছেন। গাজা যুদ্ধের ক্রমবর্ধমান আর্থিক ও কূটনৈতিক ব্যয়ের কারণে ধৈর্য্য হারিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে।

 

যদি নেতানিয়াহু আরেকটি যুদ্ধ শুরু করতে না পারেন, তাহলে আগামী বছরের নির্বাচনের আগে তিনি নানা সংকটের মুখে পড়বেন এবং সেগুলো তার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। নেতানিয়াহু কী কী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন এবং সেগুলো কতটা ভয়াবহ হতে পারে-তা এখানে আলোচনা করা হলো- 

 

নেতানিয়াহুর বিশ্ব পরিসরে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা

 

আন্তর্জাতিক পরিসরে ইসরাইল এখনকার মতো এতটা বিচ্ছিন্ন আর কখনও হয়নি। অনেকেই এর জন্য নেতানিয়াহুকে দায়ী করেন। গত দুই বছরে ইসরাইল ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে এবং ইসরাইলি আগ্রাসনে গাজায় সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের দৃশ্য বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

 

যদি নেতানিয়াহুর সরকার আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের ওপর গাজায় প্রবেশের স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা না দেয়, তবে গাজায় তার সরকারের সংঘটিত অপকর্ম বিশ্ববাসীর সামনে উন্মোচিত হয়ে যাবে; যা ইসরাইলের বিচ্ছিন্ন থাকার মেয়াদ আরও বাড়াবে।

 

কট্টর ডানপন্থীদের নেতানিয়াহুর জোট সরকারের পতন ঘটানোর শঙ্কা

 

এমনটা হতে পারে কিন্তু নেতানিয়াহু এরই মধ্যে তা এড়াতে পদক্ষেপ নিচ্ছেন। গাজায় যুদ্ধ এবং ইসরাইলের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে নেতানিয়াহু কট্টর ডানপন্থীদের ওপর ব্যাপক মাত্রায় নির্ভরশীল ছিলেন।

 

বিশেষ করে ইসরাইলের কট্টর ডানপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচ এবং জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির তার মসনদ টিকিয়ে রেখেছেন। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলে জোট ভেঙে ফেলার হুমকি দিয়েছেন তারা। যদিও যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়া সত্ত্বেও তারা এখনো নেতানিয়াহু সরকারের জোটেই আছেন।

 

এই দুই নেতার প্রস্থানের আশঙ্কায় নেতানিয়াহু এরই মধ্যে অতি কট্টরপন্থী ইয়েশিভা ছাত্রদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা হটিয়ে আইন প্রণয়ন করতে চলেছেন। এতে অতি কট্টরপন্থি দলগুলোকে জোটে ফিরিয়ে এনে নিজের সরকারকে টিকিয়ে রাখার স্বপ্ন দেখছেন নেতানিয়াহু।

 

আইসিসি ও আইসিজেতে নেতানিয়াহুর দোষী সাব্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনা

 

গাজায় গণহত্যার যুদ্ধ শুরু করার প্রায় এক বছর পর গত বছরের (২০২৪) নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) নেতানিয়াহু ও সাবেক ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের জন্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে।

 

আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) ইসরাইলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগও বিবেচনা করছে, যার জন্য দোষী সাব্যস্ত হলে নেতানিয়াহুকে দায়ী করা হবে।

 

গ্যালান্ত ও নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আইসিসি মামলার রায়ের জন্য কোনো সময়সীমার উল্লেখ নেই এবং ২০২৭ সালের আগে আইসিজের মামলার রায় ঘোষণার সম্ভাবনা নেই। দোষী সাব্যস্ত হলে আইসিসি ৩০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দিতে পারে। যদিও আইসিজে সাধারণত যেকোনো দোষী সাব্যস্ত রায় কার্যকরের জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাঠায়।

 

ট্রাম্পের নেতানিয়াহুকে ত্যাগ করার আশঙ্কা 

 

এটি একটি বাস্তব সম্ভাবনা। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের প্রধান অর্থনৈতিক ও সামরিক পৃষ্ঠপোষক। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক প্রতিকূলতার মুখে এর কূটনৈতিক ভিত্তি। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া ইসরাইল ও নেতানিয়াহু প্রকৃত সমস্যায় পড়বেন।

 

নেতানিয়াহু যা-ই দাবি করুন না কেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনের স্পষ্ট সীমারেখা রয়েছে। ২০২১ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে যখন শুরুর দিকেই অভিনন্দন জানান নেতানিয়াহু, তখন বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন ট্রাম্প। নেতানিয়াহু প্রভাবিত করতে চাইছেন, এমন আশঙ্কায় গত মে মাসে তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন ট্রাম্প।

 

সবশেষ গত সেপ্টেম্বরে কাতারের দোহায় হামাসের মধ্যস্থতাকারীদের ওপর ইসরাইলি হামলার কারণে নেতানিয়াহুর ওপর ক্ষুব্ধ হন ট্রাম্প। যুদ্ধবিরতির প্রস্তুতির বর্ণনা দিতে গিয়ে ট্রাম্প বলেন, নেতানিয়াহুর সঙ্গে তার চুক্তি হয়েছে। তিনি বলেন, ইসরাইলকে গাজায় পুনরায় সেনা মোতায়েন করতে দেওয়া হবে না।

 

৭ অক্টোবর নিয়ে নেতানিয়াহুর ব্যর্থতার তদন্ত

 

এর সম্ভাবনা ক্রমেই বাড়ছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার আগে সেনাবাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা সম্পর্কে পৃথক তদন্ত চলছে। প্রতিটি তদন্তের পর সেনা ও গোয়েন্দা প্রধান পদত্যাগ করেছেন।

 

নেতানিয়াহু যদিও এই তদন্তের ব্যাপারে কোনো আপত্তি করেননি। তবে তিনি নিজের সরকারের ভূমিকা নিয়ে তদন্তে আপত্তি জানিয়ে বলেছেন, যুদ্ধকালীন সময়ে এটি রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট ও অবাস্তব হবে।

 

কিন্তু যুদ্ধবিরতির পর ইসরাইলের হাইকোর্ট সর্বসম্মতিক্রমে রায় দিয়েছে যে, রায় বিলম্বিত করার আর কোনো বাস্তব যুক্তি নেই। সরকারকে প্রতিক্রিয়া জানাতে ৩০ দিন সময় দিয়েছেন আদালত।

 

নেতানিয়াহুর জেলে যাওয়ার সম্ভাবনা

 

ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী জন্য কারাভোগের সম্ভাবনা এখনও রয়েছে। ট্রাম্প সম্প্রতি গাজায় ইসরাইলের দীর্ঘ যুদ্ধ এবং নেতানিয়াহুর দুর্নীতির বিচারের মধ্যে সংযোগের কথা কার্যত স্বীকার করেছেন। ইসরাইলি পার্লামেন্টে ভাষণ দেয়ার সময় ট্রাম্প ইসরাইলি প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগকে নেতানিয়াহুকে ক্ষমা করার আহ্বান জানিয়েছেন।

 

বাস্তবে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে তিনটি দুর্নীতির মামলা চলছে। যার সবকটিই যুদ্ধের সময় ঘন ঘন বিলম্ব সত্ত্বেও অব্যাহত রয়েছে। ঘুষ, জালিয়াতি ও বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ প্রমাণিত হলে নেতানিয়াহুর ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।

 

তথ্যসূত্র: আল জাজিরা
 

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন