গরু-ছাগলই ভরসা চরবাসীর, তবুও নেই পশু হাসপাতাল

১০ ঘন্টা আগে
ফরিদপুর জেলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে জীবনযাপন মানেই প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই। একদিকে নদীভাঙন, খরা ও বন্যার হুমকি, অন্যদিকে যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা, স্বাস্থ্যসেবা ও অবকাঠামো সংকট। এই প্রতিকূলতার মাঝেই পদ্মার চরাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ খুঁজে নিয়েছেন জীবিকা নির্বাহের পথ। কৃষিকাজ যেখানে চাহিদা পূরণে অপ্রতুল, সেখানে ভরসা হয়ে উঠেছে গবাদি পশু পালন। বিশেষ করে গরু, ছাগল ও ভেড়া।

তবে চরাঞ্চলে নেই কোনো পশু চিকিৎসাকেন্দ্র। ফলে গবাদি পশু অসুস্থ হলে শুরু হয় মালিকদের ভোগান্তি। চিকিৎসা না পেয়ে অনেক পশু মারা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় পশুপালন নির্ভর এই অর্থনীতি। তাই চরবাসীর এখন একটাই দাবি, দ্রুত যেন চরাঞ্চলে একটি পশু হাসপাতাল স্থাপন করা হয়।


ফরিদপুর সদর উপজেলার ডিক্রিরচর ইউনিয়নের চরাঞ্চলের বাসিন্দা রফিক শেখ। কৃষি কাজের পাশাপাশি গবাদি পশু পালন করেন তিনি। তার বাড়িতে দুইটি গাভী, দুটি ষাঁড় ও ৩টি বাছুর রয়েছে। রফিক শেখ বলেন, চরাঞ্চলে কৃষিকাজ করে যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চলে না, তাই আয়ের উৎস হিসেবে গরু পালন করি। কৃষি কাজ ও গরু পালন করে যা আয় হয় তাদিয়ে সংসারের খরচ ও সন্তানের পড়ালেখা ভালোভাবেই চলে যায়।


তিনি আরও বলেন, তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে গবাদি পশুর চিকিৎসা নিয়ে। গরু অসুস্থ হয়ে পড়লে শহরে নিয়ে যেতে হয় অথবা শহর থেকে চিকিৎসক আনতে হয়। শহর থেকে চিকিৎসক আনতে হলে দুই থেকে তিন হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। চরাঞ্চলে কোনো সরকারি চিকিৎসক আসে না, বেসরকারি চিকিৎসকদের আনতে হয় সেকারণে তাদের বেশি টাকা দিতে হয়।


চরের নারীরাও পশুপালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। গৃহবধূ আছমা আক্তার বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে গরু, ছাগল ও ভেড়া পালন করি। স্বামী কৃষি কাজ করে। সংসারের সচ্ছলতা ফেরাতে আমি এগুলো লালন পালন করি। বছরে শেষে বিক্রি করে ভালোই টাকা হাতে পাই।’


তবে তিনিও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ সমস্যা হচ্ছে চরাঞ্চলে কোনো পশু চিকিৎসক নেই। পশুগুলো অসুস্থ হয়ে পড়লে ভোগান্তিতে পড়তে হয় আমাদের। মোবাইল করে ডাক্তার আনতে হয়, অনেক সময় ডাক্তার আসতে দেরি হলে মারাও যায় অনেক গরু-ছাগল। চরাঞ্চলে একটি পশু হাসপাতাল হলে আমাদের অনেক লাভ হতো।’


চরবাসী কুদ্দুস মোল্যা বলেন, 'আমার পাঁচটি গরু ও দশটি ভেড়া আছে। সম্প্রতি তার একটি গরু অসুস্থ হয়ে পড়লে শহরের এক পশু চিকিৎসককে জানাই। ডাক্তার আসতে দেরি করায় গরু প্রায় মারা যাচ্ছি। পরে ডাক্তার এসে চিকিৎসা দিলে সুস্থ হয়। কিন্তু ততক্ষণে দুই হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার থাকলে এতগুলো টাকা লাগতো না। চরাঞ্চলে একটি পশু হাসপাতাল করা হলে উপকৃত হতাম আমরা।'


জেলা প্রাণি সম্পদ কার্যালয় সূত্র জানায়, ফরিদপুর জেলার ৯টি উপজেলার ২০টি ইউনিয়নে চর রয়েছে। চরাঞ্চলগুলোতে গরু রয়েছে ১লাখ ৫১ হাজার ৮৭টি, ছাগল রয়েছে ১লাখ ৩৪ হাজার ৬৩৯ টি, ভেড়া রয়েছে ৪০ হাজার ৮৩৪টি এবং ঘোড়া রয়েছে ১ হাজার ৩৫০টি।


আরও পড়ুন: দেশি গরুতেই কোরবানির জোগান, চোরাচালান ঠেকাতে নজরদারি বাড়ানোর দাবি


এই বিপুল সংখ্যক পশুর জন্য নেই কোনো সরকারি হাসপাতাল। ফলে পশুগুলোর চিকিৎসা হয় দেরিতে, ব্যয়বহুল এবং অনিরাপদ পদ্ধতিতে।


ডিক্রিরচর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য রুবেল মোল্যা বলেন, কৃষিকাজের পাশাপাশি চরাঞ্চলের প্রতিটি পরিবারেই গবাদি পশু পালন করে থাকে। চরাঞ্চলের মানুষের অন্যতম আয়ের উৎস গবাদি পশু পালন। তবে এখানে পশু হাসপাতাল না থাকায় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।


তিনি আরও বলেন, চরাঞ্চলে একটি পশু হাসপাতাল স্থাপন করা হলে এখানকার মানুষ তাদের পশুর চিকিৎসা পেতে যে ভোগান্তি পোহাতে হয় তা দূর হতো। এছাড়া মিনি ক্লিনিক বা শহরের সরকারি পশু হাসপাতাল থেকে সপ্তাহে দুই দিন চিকিৎসক এসে চিকিৎসা দিয়ে গেলে তাতেও উপকৃত হতো চরাঞ্চলবাসী।


জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সঞ্জীব কুমার বিশ্বাস স্বীকার করেছেন চরাঞ্চলে পশু চিকিৎসা সেবায় ঘাটতি রয়েছে। তিনি বলেন, 'গবাদিপশু চরাঞ্চলের মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস। তাদের চিকিৎসা সেবার জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। শীঘ্রই তা বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে।'


তবে জনবল সংকট বড় বাধা জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমাদের ইচ্ছা থাকলেও অনেক কিছুই সম্ভব হয় না, জনবল কম। তবে আমরা চেষ্টা করবো সপ্তাহে অন্তত একদিন করে চিকিৎসক পাঠাতে।'


আরও পড়ুন: কোরবানির ঈদের আগে গরুর লাম্পি স্কিন রোগে আতঙ্কে খামারিরা


 ফরিদপুরের ২০টি চরাঞ্চলে যে পরিমাণ গবাদিপশু রয়েছে, তা শুধু চরবাসীর জীবিকাই নয়, বরং দেশের মাংস ও দুধ উৎপাদনে বড় অবদান রাখে। অথচ এই বিপুল সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণে সরকারি সহায়তা অপ্রতুল। চরবাসীর ভাষায়, 'গরু-ছাগল বাঁচলে আমাদের পরিবার বাঁচবে। পশু মারা গেলে শুধু আমরা না, রাষ্ট্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।'


কামরুল হাসান নামে এক সামাজিক সংগঠক বলেন, 'চরাঞ্চলে একটি পশু হাসপাতাল স্থাপন শুধু পশুপালকদের জন্য নয়, বরং জাতীয় প্রাণিসম্পদ রক্ষার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। তাই দ্রুত এই বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া দরকার। পাশাপাশি অস্থায়ী ও ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা ব্যবস্থাও চালু করতে হবে।'


তিনি আরও বলেন, 'এই দাবি শুধু ফরিদপুরের চরের নয়, দেশের অন্যান্য চরাঞ্চলেরও। সরকার যদি চরবাসীর এই দীর্ঘদিনের চাওয়াকে গুরুত্ব দেয়, তবে তা হবে এক বড় সামাজিক বিনিয়োগ, যা লাভবান করবে চরবাসী, প্রাণিসম্পদ খাত এবং দেশকে।'

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন