চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার নারায়নপুর ইউনিয়নের দেবিপুর গ্রামের দুরুল হোদার স্ত্রী কমেলা বেগম। একটি সেলাই মেশিন নিয়ে নৌকায় করে নদী পারাপার হচ্ছিলেন। এ সময় তার ভাড়া ৪০ টাকা ও সঙ্গের সেলাই মেশিনের ভাড়া ৩০০ টাকা দাবি করেন ঘাটের ইজারাদারদের লোকজন। এতোবেশি টাকা দিতে না চাইলে তাকে নামিয়ে দেয়া হয়। পরে বাধ্য হয়েই সেলাই মেশিনের জন্য ১৫০ টাকা ভাড়া দিয়ে নদী পার হন ওই নারী।
টোল আদায়কে কেন্দ্র করে অদ্ভুত ও চরম ভোগান্তির এই ঘটনা ঘটেছে গত সোমবার (১৩ অক্টোবর)। পাহাড়সম মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে অভিযোগ দেয়া হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. ইকরামুল হক নাহিদকে। এ নিয়ে ইাজারাদারদের তলব করা হয়। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে ইজারা বাতিলসহ প্রয়োজনীয় কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
আরও পড়ুন: বরগুনায় টোল আদায়ের নামে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি; না দিলে মারধরের অভিযোগ
কমেলা বেগম সময় সংবাদকে বলেন, ‘আমি একটি সেলাই মেশিন নিয়ে বাখের আলী ঘাটে যাই, পদ্মা নদী পার হয়ে নিজ বাড়িতে যাওয়ার জন্য। এসময় ঘাটে থাকা নৌকায় উঠার পর আমার জন্য ৪০ টাকা ও সেলাই মেশিনের জন্য ৩০০ টাকা ভাড়া দাবি করে। এটি শুনে আমার মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ে। এতোবেশি টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে আমাকে নৌকা থেকে নামিয়ে দিচ্ছিল। এসময় বাধ্য হয়েই ১৫০ টাকা দিয়ে আমি নদী পার হয়।’
প্রত্যক্ষদর্শী ফেরদৌস সিহানুক শান্ত ও জসিম আলী বলেন, ‘ঘটনাটিতে ভয়াবহ পর্যায়ের নির্যাতনের চিত্র ফুটে উঠেছে। একজন মানুষের ভাড়া যেখানে ৩০ টাকা, কিন্তু ইজারাদাররা নিচ্ছে ৪০ টাকা। একজন মানুষ পারাপারে যদি ৪০ টাকা লাগে, তাহলে একটি সেলাই মেশিন পারাপার করতে ৩০০ টাকা লাগে কোন যুক্তিতে? এসব ঘটনা স্থানীয় প্রশাসনকে দফায় দফায় জানানো হলেও তারা কোন ব্যবস্থা নেয়না। অতিরিক্ত টাকা না পেলে নামিয়ে দেয়া হয় যাত্রীদের। চরাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ তাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। এমন জুলুম-নির্যাতন বন্ধ না হলে এবার কর্তৃপক্ষকে কঠোর জবাব দেয়া হবে।’

নারায়ণপুরের বাসিন্দা আলমগীর হোসেন জানান, ‘অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েও নিরাপদে নদী পার হতে পারিনা। অতিরিক্ত লোক তোলার কারণে মাঝেমধ্যেই ঘটে নৌকাডুবির ঘটনা। এসব নৌকাডুবিতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে প্রতিবছর। গরু-ছাগল, যানবাহন ও মানুষ এক নৌকাতেই পার করা হয়। এমন অবস্থা থেকে আমরা মুক্তি চাই। স্থানীয় প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা ঘাটের সঙ্গে জড়িত থাকায় দিনের পর দিন বছরের পর বছর এমনভাবে চলতে থাকলেও কোনো প্রতিকার পায় না।’
জানা যায়, ফারাক্কার ভাটিতে ভারত থেকে আসা অতিরিক্ত পানির প্রভাবে প্রায় দেড় মাস ধরে পানিবন্দি চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের প্রায় ১১ হাজার পরিবার। এরমধ্যে কয়েকদিন পরপর দফায় দফায় পানি কমছে ও বাড়ছে। প্রমত্তা পদ্মায় পানি কমলে বা বাড়লেই নদী তীরবর্তী এলাকায় দেখা যায় তীব্র ভাঙন। এমন পানিবন্দি ও ভাঙনের অবস্থাতে ভারতীয় সীমান্তবর্তী চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের নতুন ভোগান্তি পদ্মা নদীতে থাকা খেয়াঘাটগুলো। এসব খেয়াঘাটে নেয়া হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া।
উপজেলা প্রশাসনের বেঁধে দেয়া ভাড়ার তালিকায় নেই সেলাই মেশিনের ভাড়া। টোল পারাপারের তালিকায় চালকসহ একটি মোটরসাইকেলের ১০০ টাকা, তেলভর্তি ব্যারেলে ৩০ টাকা, প্রতি বস্তা সার ৩০ টাকা, প্রতি বান্ডিল টিন ও রড পারাপারের জন্য ১০০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। কোন যুক্তিতে একটি সেলাই মেশিনের ভাড়া ৩০০ টাকা দাবি করা হয়েছে এর কোন সদুত্তর দিতে পারেনি ইজারাদাররা।
আরও পড়ুন: একের পর এক স্বর্ণের দোকানে চুরিতে উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা, কী বলছে পুলিশ?
এদিকে, ইজারাদারদের যোগসাজশে নদীতে নৌকার সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। উপজেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ইজারাদার পুনরায় ইজারা দেয়। ফলে হাতবদল হওয়ায় অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হয় যাত্রীদের। ঘাট ইজারাদার সাদিকুল ইসলাম অতিরিক্ত ইজারা দাবি আদায়ের ঘটনাটি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা বানোয়াট অভিযোগ দেয়া হয়েছিল ইউএনও স্যারের কাছে। এনিয়ে তার (ইউএনও) সঙ্গে দেখা করেছি। সেলাই মেশিনের জন্য ৩০০ টাকা দাবি বা ১৫০ টাকা আদায় করা হয়নি।’
ইজারাদারদের অংশীদার মো. ইমরানও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়টি অস্বীকার করেন। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. ইকরামুল হক নাহিদ মুঠোফোনে সময় সংবাদকে জানান, ‘সেলাই মেশিন নিয়ে পারাপারের সময় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের একটি অভিযোগ পাওয়া গেছে। এরপর ইজারাদারদের ডাকা হয়েছিল। তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে। এর আগেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। আগামীতে এমন ঘটনা ঘটলে ইজারা বাতিলসহ কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
প্রসঙ্গত, গত বছর অতিরিক্ত টোল আদায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে শিবগঞ্জ উপজেলায় ইজারাদারদের ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় স্থানীয়রা। চলতি বছর ভাগরথি জোহরপুর ঘাট ২৯ লাখ ৫০০ টাকা ও বাখের আলী ঘাট ৩৬ লাখ ৩৫ হাজার টাকায় ইজারা দেয়া হয়।
]]>
১ সপ্তাহে আগে
২







Bengali (BD) ·
English (US) ·