খুলনার জাহাজ মেরামত শিল্পে ধস

১১ ঘন্টা আগে
মোংলা বন্দরকেন্দ্রিক আমদানি কমে যাওয়া, নৌপথে পণ্য পরিবহন হ্রাস এবং জাহাজ নির্মাণের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধিতে ধস নেমেছে খুলনার জাহাজ মেরামত শিল্পে। এক সময়ের জমজমাট ডকইয়ার্ডগুলো এখন কাজের অভাবে স্থবির হয়ে পড়েছে। শত শত শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন, বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে লোকসানের মুখে।

জাহাজ, লঞ্চ, কার্গো ও স্টিমার নির্মাণ-মেরামত ও আধুনিকায়নে এক দশক আগেও দাপট ছিল খুলনার। ভৈরব ও রূপসা নদীর তীরে গড়ে ওঠা ডকইয়ার্ডগুলো একসময় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নৌযান মেরামত ও নির্মাণের প্রাণকেন্দ্র ছিল। কয়েক বছর আগেও সারি সারি জাহাজ দাঁড়িয়ে থাকত মেরামতের জন্য। এখন সেই দৃশ্য ইতিহাস। অর্ধশতাধিক ডকইয়ার্ডের মধ্যে সচল রয়েছে মাত্র ১০-১২টি।

 

প্রায় দুই যুগ আগে নদীর দুই পাড়ে গড়ে ওঠে অর্ধশতাধিক ডকইয়ার্ড প্রতিষ্ঠান। পাঁচ বছর আগেও প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সামনে নদীর তীরে ৪-৫টি করে জাহাজ দেখা যেত। সম্প্রতি নদীর তীর ঘুরে দেখা গেছে হাতে গোনা তিন-চারটি প্রতিষ্ঠানে সব মিলিয়ে ১০-১২টি জাহাজের মেরামত বা সংস্কারের কাজ চলছে। মালিক-শ্রমিকদের মতে, গত দুই বছরে কাজ কমেছে সবচেয়ে বেশি।

 

মূলত মোংলা বন্দরকেন্দ্রিক আমদানি কমে যাওয়া, একের পর এক নৌরুট বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং পণ্য পরিবহন হ্রাসই এর প্রধান কারণ। নৌপথে পণ্য পরিবহন কমে যাওয়ায় জাহাজ মেরামতের প্রয়োজনও কমে গেছে। ফলে ডকইয়ার্ডগুলোতে কাজের পরিমাণ কমে, বন্ধ হয়ে গেছে অন্তত ১০টি প্রতিষ্ঠান। কিছু প্রতিষ্ঠান টিকে আছে কোনোরকমে।

 

রূপসা নদীর পাড়ে লোহার পাত কেটে জাহাজের কাঠামো মেরামতের কাজে ব্যস্ত শ্রমিক রহিম শেখ বলেন, ‘আগে মাসে তিন-চারটা বড় জাহাজে কাজ করতাম। এখন পুরো মাসে একটা কাজও মেলে না। সংসার চালানোই কষ্টকর হয়ে পড়েছে।’

 

টিকে থাকার লড়াইয়ে এখন খুলনার ভৈরব–রূপসার তীরের একসময়ের জমজমাট ডকইয়ার্ডগুলো। ছবি: সময় সংবাদ

 

একই এলাকার শ্রমিক হাবিবুল্লাহ জানান, ডকইয়ার্ডে কাজ না থাকায় অনেকেই পেশা বদলে ফেলেছে। কেউ দিনমজুর, কেউ রিকশা চালাচ্ছে। আগে যেখানে সারিবদ্ধ জাহাজ থাকত, এখন সেখানে নীরবতা।

 

ডকইয়ার্ড মালিকরা বলছেন, আমদানি ও নৌপথে পণ্য পরিবহন কমে যাওয়ায় জাহাজগুলো অলস পড়ে আছে। ফলে মেরামতের প্রয়োজনও কমে গেছে। তাছাড়া জাহাজ নির্মাণে ব্যবহৃত কাঁচামালের দাম দ্বিগুণ হওয়ায় নতুন জাহাজ তৈরির আগ্রহও হারিয়ে ফেলেছেন অনেক মালিক।

 

আরও পড়ুন: খুলনা নগরের বস্তিবাসীর কষ্ট দেখার কেউ নেই!

 

রকি ডকইয়ার্ডের পরিচালক রিয়াসুদ আলম রকি বলেন, ‘আগে কেজি প্রতি ৬০-৭০ টাকায় লোহার পাত কিনতাম, এখন তা ১১০ টাকা। রড, রংসহ সব উপকরণের দাম বেড়ে গেছে। ফলে জাহাজ নির্মাণে খরচ বাড়লেও অর্ডার কমে গেছে। মূলত মোংলা বন্দরে আমদানি কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে ডকইয়ার্ডগুলোতে। জাহাজ অলস বসে থাকলে তো আর কেউ মেরামত করবে না।’

 

একই চিত্র দেখা যাচ্ছে জাহাজ মালিকদের দিকেও। পণ্য পরিবহন কমে যাওয়ায় আয় কমে গেছে, অথচ মেরামতের খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ। জাহাজ মালিক সাদমান আলম কাগজি বলেন, ‘একটি জাহাজ সংস্কারে এখন খরচ হয় ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা। পণ্য পরিবহন কমে যাওয়ায় ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক মালিক তাদের জাহাজ কেটে বিক্রি করছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, অনেকগুলো বন্ধ হওয়ার পথে।’

 

খুলনার ভৈরব–রূপসার তীরের একটি ডকইয়ার্ডে শ্রমিকরা জাহাজ মেরামতের কাজ করছেন। ছবি: সময় সংবাদ

 

২০১৯-২০ অর্থবছরে খুলনার প্রথম সারির ৬টি ডকইয়ার্ডে মাসিক গড় আয় ছিল ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে এক লাখ টাকারও কমে। ছোট ডকইয়ার্ডগুলোর আয় অর্ধেকে নেমে গেছে।

 

বৃহত্তর খুলনা ডকইয়ার্ড মালিক সমিতির সভাপতি মো. সালাহ উদ্দিন খান বলেন, ‘অনেক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে গেছে। বড়রা কোনোভাবে টিকে আছে, কিন্তু ছোট ডকইয়ার্ডগুলো বাঁচানো এখন বড় চ্যালেঞ্জ।’

 

আরও পড়ুন: খুলনায় আবারও সক্রিয় জাল নোট কারবারিরা

 

অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি সৈয়দ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে নৌপথে পণ্য পরিবহন বাড়াতে হবে। সরকারকে এজন্য এগিয়ে আসতে হবে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে মোংলা বন্দর দিয়ে আমদানি কমেছে। সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী অন্তত ৪০ ভাগ পণ্য মোংলা বন্দর দিয়ে আমদানি নিশ্চিত করতে হবে। নৌপথ সচল না থাকলে জাহাজ শিল্পও টিকবে না।’

 

একসময় খুলনার ডকইয়ার্ডগুলোতে প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান ছিল। এখন টিকে আছেন দুই হাজারেরও কম। অনেকেই কাজের অভাবে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।

 

একসময় খুলনা ছিল বাংলাদেশের জাহাজ মেরামত শিল্পের গর্ব। এখন সেই শিল্প টিকে থাকার লড়াই করছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি সহায়তা ও ব্যাংকগুলোর স্বল্পসুদে ঋণ না পেলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন