খুলনার জলাবদ্ধতা: ব্যর্থতা প্রশাসনের না প্রকল্প বাস্তবায়নের?

৬ ঘন্টা আগে
বর্ষা মৌসুমে খুলনা নগরীর অন্যতম প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা। যা নিরসনে বছরের পর বছর সিটি করপোরেশনের প্রকল্প চললেও মিলছে না প্রত্যাশিত সুফল। সামান্য বৃষ্টিতেই ডুবে যাচ্ছে শহরের অধিকাংশ এলাকা। নগরবাসীরা বলছেন, এটি মূলত প্রশাসনিক ব্যর্থতার ফল। বিশেষজ্ঞরাও জোর দিচ্ছেন টেকসই পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার ওপর।

বর্ষা এলেই খুলনা শহরের বাসিন্দাদের কাছে ফিরে আসে জলাবদ্ধতার পুরোনো দুঃসহ স্মৃতি। এ বছরও আষাঢ়ের প্রথম ভারী বর্ষণেই ডুবে গেছে নগরীর বিভিন্ন অংশ। পুরো মৌসুম জুড়েই জলাবদ্ধতার আশঙ্কা করছে খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) নিজেই।

 

কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতেই নগরীর প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে যায়। নাগরিক ভোগান্তি বেড়েই চলছে। অথচ খরচ হয়েছে শত শত কোটি টাকা। খাল খনন, ড্রেন নির্মাণ, স্লুইস গেট বসানো-প্রকল্পের শেষ নেই, কিন্তু দৃশ্যমান সুফল নেই বললেই চলে। নগর পরিকল্পনাবিদ ও গবেষকরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতি, খাল দখল ও প্রশাসনিক উদাসীনতায় খুলনার জলাবদ্ধতা আজ দীর্ঘমেয়াদি সংকটে পরিণত হয়েছে।

 

আরও পড়ুন: স্কুল মাঠ যেন বিস্তীর্ণ জলাধার, দুর্ভোগ

 

২০১৯ সালে কেসিসি নেয় একটি বৃহৎ ড্রেনেজ উন্নয়ন প্রকল্প। ৮২৩ কোটি টাকার এ প্রকল্পে রয়েছে ৯টি খাল খনন, ৮টি স্লুইস গেট, প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি ড্রেন নির্মাণ, আউটলেট খনন, জমি অধিগ্রহণ ও যন্ত্রপাতি সংগ্রহসহ ময়ূর নদীর ওপর তিনটি সেতু নির্মাণ। ২০২৩ সালে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও অগ্রগতি আশানুরূপ নয়।

 

এছাড়া গত সাত বছরে ৬৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৯৮টি ড্রেন পুনর্নির্মাণ করেছে কেসিসি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বর্ষা এলেই খুলনার রাজপথে নামে পানির স্রোত।

 

নগরীর পানি রূপসা নদীতে যাওয়ার অন্যতম পথ লবণচরা খাল। তবে সড়ক সংস্কার ও কালভার্ট নির্মাণের কারণে খালটির মুখ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। এতে জমছে আবর্জনা ও কচুরিপানা, ফলে ব্যাহত হচ্ছে পানি নিষ্কাশন। শুধু লবণচরা নয়-মতিয়াখালি, ক্ষেত্রখালী, নিরালা, খানজাহান আলী রোডসহ অন্তত ১০টি এলাকার খাল ও ড্রেনের মুখেও বাঁধ বা ময়লা জমে আছে।

 

অবৈধ দখল, অনিয়মিত বর্জ্য অপসারণ, জলাশয়ের পরিমাণ কমে যাওয়া ও প্রকল্প বাস্তবায়নে সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতা জলাবদ্ধতা আরও জটিল করে তুলেছে। অল্প বৃষ্টিতেই অলিগলি তো বটেই, মূল সড়কেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানি জমে থাকে। কোথাও কোথাও বাড়িঘরের ভেতরে পানি উঠে ২-৩ দিন পর্যন্ত অবস্থান করে।

 

 

টুটপাড়া মহির বাড়ি এলাকার রিকশাচালক শাহজাহান বলেন, ‘তিনদিন ধরে বাড়ি পানির নিচে। রিকশাটা বের করতে পারিনি। আয়-রোজগার একেবারে বন্ধ।’

 

লবণচরা এলাকার আব্দুল মান্নান বললেন, ‘শুধু ড্রেনের কাজ করে বছরের পর বছর। কিন্তু বৃষ্টির পর দুইদিন পর্যন্ত রাস্তায় পানি জমে থাকে, সমাধান নেই।’

 

ক্ষেত্রখাল এলাকার রুবেল শেখ জানান, প্রত্যেকটা খালের মুখে ময়লা জমে থাকে। সিটি করপোরেশন পরিষ্কার করে না। তখনই পানি আটকে রাস্তাঘাট ডুবে যায়।

 

টুটপাড়ার সেলিনা বেগম বলেন, ‘ঘরের আসবাবপত্র সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। খাট, আলমারি সব ভিজে গেছে। পানি ওঠার পর কয়েকদিন শুকাতেই পারি না।’

 

কেসিসির প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা আবির উল জব্বার বলেন, ‘নগরবাসীর সমস্যা সমাধানে ড্রেনেজ প্রকল্প বাস্তবায়ন চলছে। তবে ২০১৩ সালে নেয়া প্রকল্পগুলোর জন্য নির্ধারিত নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য এখন দ্বিগুণেরও বেশি। নতুন বরাদ্দ ছাড়া কাজ এগোনো সম্ভব নয়। আমরা যতই ড্রেন নির্মাণ করি, যদি আবর্জনা পরিষ্কার না হয়, তাহলে জলাবদ্ধতা কমবে না। নতুন একটি প্রকল্পে স্লুইস গেট ও পাম্প হাউস বসানোর পরিকল্পনা আছে। এটি বাস্তবায়ন হলে পরিস্থিতি উন্নত হবে।’

 

তবে প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা ও অর্থ সংকটের কারণে এই সমস্যার সমাধান এখনও অনিশ্চিত-এ কথাও স্বীকার করেন আবির উল জব্বার। আর খুলনা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, ‘উন্নয়নের নামে শুধু টাকা খরচ হচ্ছে, কাজ হচ্ছে না। কেসিসি কখনো আন্তরিকভাবে জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করেনি।’

 

আরও পড়ুন: খুলনায় উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় ভোটকেন্দ্র সংস্কারে অগ্রাধিকার

 

নগর পরিকল্পনাবিদ ও কুয়েটের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক ড. তুষার কান্তি রায় বলেন, ‘খুলনার জলাবদ্ধতা মৌসুমি নয়, এটি ক্রমবর্ধমান দীর্ঘমেয়াদি সংকট। শুধু ড্রেন কাটা বা খাল খনন যথেষ্ট নয়। জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে, প্রাকৃতিক নিষ্কাশনের পথ বন্ধ। প্রয়োজন সমন্বিত, টেকসই ও প্রকৃতিবান্ধব পরিকল্পনা।’

 

তিনি আরও বলেন, ‘গত এক দশকে নগরের সীমান্ত ঘেঁষে ৫৯ বর্গকিলোমিটার এলাকা অপরিকল্পিতভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। এসব এলাকায় নেই কোনো সুষ্ঠু ড্রেনেজ ব্যবস্থা বা পরিকল্পনা। এর চাপ পড়ছে মূল শহরেও।’

 

ওয়ার্ল্ড ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী, খুলনা বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ নগরীগুলোর একটি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকি আরও বাড়ছে। অথচ জলাবদ্ধতা নিরসনে কোনো সুদূরপ্রসারী সমাধান এখনো চোখে পড়ে না। কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও সুফল নেই। তাই সময় এসেছে পুরোনো ধারার প্রকল্প নয়, নগরবাসীর বাস্তব অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ সংকট মাথায় রেখে খুলনার জন্য টেকসই ও গণমুখী নগর পরিকল্পনা গ্রহণের।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন