খুলনার আদালতে ৭৫ হাজার মামলার জট: বিচারের অপেক্ষায় ভুক্তভোগীরা

২ সপ্তাহ আগে
খুলনার আদালতগুলোতে প্রায় ৭৫ হাজার মামলার বিচারকাজ না হওয়ায় চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন বিচার প্রত্যাশিরা। বর্তমানে খুলনার ৫৪টি আদালতে কর্মরত আছেন মাত্র ৫৩ জন বিচারক। বিচারক সংকট, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এবং ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় ভারসাম্য হারাতে বসেছে খুলনার বিচারব্যবস্থা।

আদালতের বাইরে প্রতিদিন জমে থাকা অপেক্ষার সারি আর বারান্দাজুড়ে থাকা দীর্ঘশ্বাসগুলো বলছে—বিচার ব্যবস্থায় গতি আনা এখন সময়ের দাবি। সংশ্লিষ্টদের মতে, মামলার জট কমাতে প্রয়োজন প্রযুক্তির ব্যবহার, সাক্ষীদের নিরাপত্তা, আইনজীবীদের আন্তরিকতা ও বিচার ব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কারও।

 

দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন ৮২ বছর বয়সী ননী গোপাল মণ্ডল নামে একব্যক্তি। পৈতৃক সম্পত্তি ফিরে পেতে জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও পাননি কাঙ্ক্ষিত বিচার। দুই-তিন মাস পরপর ডুমুরিয়া থেকে ২০ কিলোমিটার পথ পারি দিয়ে খুলনার আদালতে হাজিরা দিতে আসেন আশায়, ফিরে যান হতাশা নিয়ে। বার্ধক্য, শারীরিক দুর্বলতা আর সীমাহীন ভোগান্তির মাঝেও ন্যায়বিচারের আশায় প্রহর গুণছেন তিনি।

 

আরও পড়ুন: খুলনায় আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল, গ্রেফতার আরও ৩

 

ননী গোপালের মতো হাজারো মানুষ প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকেন খুলনার আদালত প্রাঙ্গণে বিচারের আশায়। কেউ হাজিরা দিতে, কেউ সাক্ষ্য দিতে, কেউ বা শুধুই পরবর্তী তারিখ জানার জন্য আসেন। দিনের পর দিন এভাবেই তারা অপেক্ষা করছেন।

 

সরকারি কৌশুলিদের দেয়া তথ্যমতে, খুলনার জেলা ও মহানগর দায়রা আদালত, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালসহ ৫৪টি আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৭৫ হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে রয়েছে সর্বোচ্চ ১২ হাজার মামলা। এছাড়া যুগ্ম মহানগর আদালতে ৮ হাজার, নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের তিনটি আদালতে রয়েছে ৬ হাজারের বেশি মামলা। এসব মামলার অনেকগুলোর নিষ্পত্তি হয়নি এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। এতে অপচয় হচ্ছে সময় ও অর্থ, বাড়ছে সাধারণ মানুষের হতাশা আর ক্ষোভ।

 

তেরখাদা উপজেলার পঞ্চাশোর্ধ্ব সেলিম হায়দার একটি হত্যা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে গত ১০ বছর ধরে আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন।

 

তিনি বলেন, আমি দোষী হলে শাস্তি চাই, নির্দোষ হলে চাই মুক্তি। কিন্তু এ অনিশ্চয়তায় কাটছে দশ বছর।

 

দিঘলিয়া উপজেলার নার্গিস বেগম বলেন, আমার বাড়িতে ডাকাতি হয়েছিল সাত বছর আগে অথচ আমাকে বছরের পর বছর হাজিরা দিতে হচ্ছে। এটা কষ্টকর ও অবিচার।

 

মাদক মামলার সাক্ষী নাইম হাসান বলেন, ঘটনাটা ১২ বছর আগের, এখন কিছুই মনে নেই। তবুও তিন বার সাক্ষ্য দিতে এসে সময়, টাকা আর শ্রম নষ্ট করলাম।

 

আরও পড়ুন: কুয়েট উপাচার্যের পদত্যাগ চাইছে শিক্ষক সমিতি

 

আরেক ভুক্তভোগী রিকশাচালক মতিয়ার শেখ বলেন, ছোট একটা মারামারির মামলায় ২০১৪ সালে আটক হই। জামিনে আছি, কিন্তু এখনও রায় হয় নাই। কাজ কাম সব নষ্ট হয় হাজিরা দিতে গিয়ে। এমন অসংখ্য ভুক্তভোগীর দেখা মেলে খুলনার আদালত চত্বরে যারা ঘুরপাক খাচ্ছেন বছরের পর বছর ধরে।

 

সিনিয়র আইনজীবী মমিনুল হক বলেন, মামলার জট কমাতে হলে বাদী-বিবাদী উভয়পক্ষের আন্তরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। সময় মতো পুলিশ প্রতিবেদন জমা দেয়া, অপ্রয়োজনীয় মামলা কমানো এবং বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির পথ উন্মুক্ত করলেই পরিবর্তন সম্ভব।

 

আইনজীবী রেহানা পারভীন বলেন, বিচারকদের সংখ্যা কম ও সাক্ষীরা নিয়মিত অনুপস্থিত থাকেন, ফৌজদারি মামলায় পুলিশ সময় মতো প্রতিবেদন দেয় না—এইসব কারণে বিচার বিলম্বিত হচ্ছে। দ্রুত সমাধান ছাড়া মামলার জট আরও ভয়াবহ আকার নিতে পারে।

 

খুলনার পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) তৌহিদুজ্জামান তুষার বলেন, সরকারের উদ্যোগে কিছুটা উন্নতি হলেও খুলনায় আদালতের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কম। মামলার চাপে বিচারকরা কার্যত জর্জরিত। নতুন আদালত স্থাপন জরুরি।

 

সরকারি কৌঁসুলি মো. জাকির হোসেন বলেন, শুধু বিচারকই নয়, মামলার কার্যক্রমে সম্পৃক্ত অন্যান্য সহায়ক জনবল যেমন পেশকার, জারিকারক, ক্লার্ক—সবক্ষেত্রেই রয়েছে তীব্র সংকট। এসব সমস্যা সমাধানে সরকারকে এখনই এগিয়ে আসতে হবে।

 

 

 

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন