রূপসা ওয়াপদা বস্তির কিশোরী উর্মি খাতুন নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করলেও এক বছর আগে সংসারের খরচ চালাতে স্কুল ছাড়তে হয়েছে তাকে। এখন বাবার ছোট্ট হোটেলে কাজ করেন উর্মি। বস্তির সামনে বাবার সেই হোটেলেই কথা হয় তার সঙ্গে। পাশের করোনেশন মাধ্যমিক বিদ্যানিকেতনে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন তিনি।
উর্মি বলেন, ‘আমার বান্ধবীরা এখনও স্কুলে যায়, আমারও যেতে ইচ্ছে করে। তবে বাবার দিকটাও তো দেখতে হবে। বাবার আর্থিক অবস্থা আরেকটু ভালো হলে হয়তো পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে পারতাম।’

শুধু উর্মিই নয়, নগরীর প্রায় প্রতিটি বস্তিতেই অসংখ্য শিশু-কিশোর আছে, যাদের অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষা ছেড়ে কাজে নামতে বাধ্য হয়েছে। কেউ খাবারের ঠোঙা বিক্রি করছে, কেউ ঝালাই মেশিনের শব্দে কানে তুলো গুঁজে দিন কাটাচ্ছে, কেউবা ইটভাটার চুল্লির সামনে ঘাম ঝরাচ্ছে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সিডিপির জরিপে বলা হয়েছে, খুলনার বস্তি এলাকায় স্কুলছুট শিশুদের হার ২৩ শতাংশ। শিক্ষা থেকে বঞ্চিত এই শিশুদের সংখ্যা শহরের ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত। শিশু শ্রমে যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি তারা নানা ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও নিয়োজিত হচ্ছে। এর ফলে অল্প বয়সেই শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে তারা।
আরও পড়ুন: খুলনায় চাষ হচ্ছে মরুভূমির ফল সাম্মাম
খুলনার বস্তিগুলোতে প্রতিদিন বেঁচে থাকার লড়াই যেন এক অনন্ত যুদ্ধ। শিশুদের কণ্ঠে স্কুলের গান নয়, শোনা যায় শ্রমের ক্লান্ত সুর। মায়েরা সারাদিন দৌড়ে বেড়ান পানির খোঁজে, আর অসুস্থদের জন্য নেই ন্যূনতম চিকিৎসার নিশ্চয়তা।
শিক্ষার পাশাপাশি নাগরিক সমস্যার ছড়াছড়ি খুলনার বস্তি এলাকাগুলোতে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউআরপি ডিসিপ্লিন ও ইউএনডিপির গবেষণায় দেখা গেছে, বস্তির অন্তত ২০ শতাংশ পরিবার এখনও খোলা বাথরুম ব্যবহার করছে। যেসব বস্তিতে কমিউনিটি টয়লেট আছে, সেগুলোও খুবই অপ্রতুল। একটি টয়লেট ব্যবহার করছে ১৫ থেকে ২০ পরিবার। এর ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি স্থায়ীভাবে থেকে যাচ্ছে।

অর্ধেকেরও বেশি বস্তিতে ওয়াসার সংযোগ নেই। যেসব বস্তিতে লাইন আছে, সেখানেও পানি পাওয়া যায় না নিয়মিত। গ্রীষ্মকালে এই সংকট আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। অনেক পরিবার দূরের নলকূপ বা পাইপের পানি কিনে ব্যবহার করে। যাদের সামর্থ্য নেই, তারা অস্বাস্থ্যকর পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। ফলে প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে পড়ছে আমাশয়, ডায়রিয়া, চর্মরোগের মতো রোগব্যাধি।
শুধু পানি ও স্যানিটেশন নয়, বসবাসের পরিবেশও অমানবিক। শহরের অন্য এলাকায় প্রতি একরে যেখানে ১০০ জন বাস করে, সেখানে বস্তিতে বাস করছে পাঁচশোরও বেশি মানুষ। সরু গলিপথ, ময়লা-আবর্জনায় ভরা ড্রেন, খেলার মাঠহীন অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে বেড়ে উঠছে হাজারো শিশু। গ্রীষ্মে গরমে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে ঘর, বর্ষায় হাঁটু পানি জমে থাকে রাস্তায়, শীতে বাতাস ঠেকানোর সামর্থ্য নেই কুঁড়েঘরে।
আরও পড়ুন: হাতবদল ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে অধরাই কৃষকের ন্যায্যমূল্য
ভুক্তভোগী বস্তিবাসীরা বলছেন, তাদের সমস্যা শোনার মতো কেউ নেই। নতুন বাজার ওয়াপদা বস্তির আসমা বেগম বলেন, ‘এখানে সমস্যার শেষ নেই। সরু সড়ক, ল্যাট্রিন সংকট, স্ল্যাববিহীন ড্রেন, মশা, আবর্জনায় সব সময়ই অসুস্থ থাকে মানুষ। এনজিওগুলো মাঝে মধ্যে কিছু সহায়তা দেয়, তবে তা খুবই সামান্য। সরকারি সাহায্য বা বরাদ্দ কিছুই মেলে না। একটি বাথরুম ব্যবহার করতে হয় ১৫ থেকে ২০ পরিবারকে। সকাল বেলায় লাইন পড়ে যায়। এটা স্বাস্থ্যসম্মত নয়, রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।’
নগরীর আরেক প্রান্তে রেলওয়ে সংলগ্ন গ্রীন লাইন বস্তির ৬টি ব্লকে বাস করছে প্রায় ২৫০০ পরিবার। নগরীর সব থেকে বড় বস্তি এটি। এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা সুপেয় পানি। মাত্র একটি ব্লকে কয়েকদিন আগে ওয়াসার সংযোগের কাজ শুরু হয়েছে। বছরের পর বছর ভুগছেন তারা এই সংকটে।
বস্তিবাসী সুলতান আহমেদ বলেন, ‘এখানে পানির সমস্যা সবচেয়ে বেশি। এত পরিবার থাকলেও সরকার বা কেউই এর সমাধান করে না। কখনও দূর থেকে পানি আনতে হয়, কখনও অস্বাস্থ্যকর পানি খেতে ও ব্যবহার করতে হয়।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব সমস্যা নতুন নয়। সরকারি উদ্যোগের অভাবেই পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আশিকুর রহমান বলেন, ‘বস্তিবাসীদের জন্য নেওয়া প্রকল্পগুলো টেকসই হয় না। প্রতিটি বস্তির অবকাঠামো উন্নয়নে আলাদা পরিকল্পনা দরকার। কিছু এনজিও সহায়তা করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। এনজিও একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রকল্প চালায়। প্রকল্প শেষ হলে সরকারের উচিত তা চালিয়ে নেওয়া, কিন্তু সেটা হয় না। প্রতিটি নাগরিকের সেবা পাওয়া অধিকার। এজন্য রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে। সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, কেডিএ—এসব সংস্থাকে দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প হাতে নিতে হবে। না হলে অদূর ভবিষ্যতে সংকট আরও বাড়বে।’
আরও পড়ুন: খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কে ৮ মাসে ৩৬ দুর্ঘটনায় হতাহত ৬৩
খুলনা সিটি কর্পোরেশনও স্বীকার করছে, সীমিত সম্পদ ও জনবল সংকটের কারণে সব চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা আবির উল জব্বার বলেন, ‘প্রতি বছরই কিছু উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়। তবে সব বস্তিতে একসঙ্গে কাজ করা যায় না। ধাপে ধাপে কাজ চলছে।’
তবে বাস্তবতা হলো, বেসরকারি সংস্থার ক্ষুদ্র প্রকল্প দিয়ে এত বড় সংকট সমাধান সম্ভব নয়। পর্যাপ্ত সরকারি বরাদ্দ ছাড়া বস্তিবাসীর জীবনমান উন্নয়ন কল্পনাও করা যায় না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানি ও স্যানিটেশনের মতো মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত এই মানুষগুলো শহরের সমান নাগরিক হলেও বাস্তবে তারা বৈষম্যের শিকার।
]]>