সেনপাড়া মেঘনা কলোনিতে শতাধিক পরিবারের একমাত্র পানির উৎস একটি টিউবওয়েল। তবে গত দুই মাস ধরে সেটি থেকে নিয়মিত পানি পাওয়া যাচ্ছে না। কলোনিবাসী প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে পানি সংগ্রহ করছেন।
শাহানা বেগম, মেঘনা কলোনির বাসিন্দা বলেন, ‘সকালে উঠে দেখি টিউবওয়েলে পানি নেই। বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানো, রান্নাবান্না—সবকিছু থমকে যায়। এক কলস পানি আনতে এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়।’
জসিম উদ্দিন, দৌলতপুর এলাকার একজন দোকানদার বলেন, ‘ওয়াসার সংযোগ নেই। বাধ্য হয়ে পাম্প লাগিয়ে সাব মার্সিবল দিয়েছি। কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকলে সেটাও চলে না। এখন তো পাম্প দিয়ে পানি তুলতেও অনেক সময় লাগে।’
আরও পড়ুন: রাঙ্গামাটির পাহাড়ে পানির কষ্ট, সমাধানে আসে না জনপ্রতিনিধি-প্রশাসন!
পানি সংকট শুধু মেঘনা কলোনিতে নয়, দৌলতপুর, শিরোমনি, খালিশপুর ও সোনাডাঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকায় একই অবস্থা। খুলনা ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, শহরের প্রায় ৭০ হাজার পরিবারের মধ্যে সংযোগ পেয়েছে মাত্র ৪১ হাজার। প্রতিদিনের চাহিদা ১৯ কোটি লিটার হলেও সরবরাহ হচ্ছে ১১ কোটি লিটারেরও কম, অর্থাৎ ৬০ শতাংশের মতো।
ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা বেড়েই চলেছে
ওয়াসার পানির অভাবে অনেকে এখন সাব মার্সিবল পাম্প স্থাপন করে ব্যক্তিগতভাবে পানি সংগ্রহ করছেন। খুলনায় বর্তমানে অনুমানিক ১৫ হাজারেরও বেশি সাব মার্সিবল পাম্প রয়েছে। এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর গত এক দশকে ১০ থেকে ১৫ ফুট পর্যন্ত নেমে গেছে।
ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (IWM) এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে যেমন সংকট ঘনাচ্ছে, তেমনি বিকল্প উৎসের অভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে। তারা নদীর পানি পরিশোধন, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, MAR (Managed Aquifer Recharge) প্রযুক্তি প্রয়োগ এবং পানির ন্যায্যমূল্য নির্ধারণে ওয়াটার রেগুলেটরি কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছেন।
ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং সহযোগী বিশেষজ্ঞ, মো. আব্দুল্লাহ বলেন, ‘অতিরিক্ত হারে ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলন ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক হুমকি। পানির স্তর নিচে নেমে গেলে তা পুনরুদ্ধার করা অনেক সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। আমাদের এখনই ভূ-পৃষ্ঠের পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে।’
নতুন প্রকল্প নিচ্ছে ওয়াসা
খুলনা ওয়াসা বলছে, সংকট কাটাতে তারা নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। শহরের বাকি প্রায় ৬ লাখ বাসিন্দাকে সেবার আওতায় আনতে শুরু হয়েছে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা।
আরও পড়ুন: নেত্রকোনার পাহাড়াঞ্চলে পানির কষ্ট দূর হবে কবে?
খুলনা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. হুসাইন শওকত বলেন, ‘আমরা নতুন কিছু পাইপলাইন স্থাপন এবং বিদ্যমান পরিকাঠামো উন্নয়নের প্রকল্প শুরু করেছি। আশা করছি আগামী দুই বছরে সব পরিবারকে ওয়াসার আওতায় আনতে পারব।’
খুলনার প্রায় ১৫ লাখ মানুষের বড় একটি অংশ এখনও বিশুদ্ধ পানি পাওয়ার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই ব্যবস্থা না নিলে আগামীতে পানির সংকট আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
খুলনার সুপেয় পানির সংকট কোনো একক কারণে নয়—এটি একটি বহুমাত্রিক সমস্যা। ভূগর্ভস্থ পানির ক্রমাগত অবনমন, ওয়াসার অপ্রতুলতা ও সচেতনতার অভাব মিলিয়ে শহরজুড়ে তৈরি হয়েছে এক গভীর সংকট। এ থেকে উত্তরণের জন্য বাস্তবভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয় এবং নাগরিক পর্যায়ের জোরাল সচেতনতার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।