কর্মজীবী নারীদের বৈশ্বিক মহামারি মোকাবিলার সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আইসিডিডিআর,বি’র গবেষণা

২ সপ্তাহ আগে
শহরে বস্তি এবং পোশাক কারখানায় কর্মরত নারীদের মহামারি মোকাবিলায় আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে গবেষণা করছে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডাইরিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)। এই নিয়ে রাজধানী ঢাকায় একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বুধবার ( ২৫ জুন) আইসিডিডিআর,বি’র মহাখালীর সাসাকাওয়া অডিটোরিয়ামে ‘বাংলাদেশের শহরের অনানুষ্ঠানিক বসতিগুলিতে বসবাসকারী কর্মজীবী মহিলাদের মধ্যে বৈশ্বিক মহামারি প্রস্তুতির জন্য সিস্টেম শক্তিশালীকরণ’ শীর্ষক এই অলোচনা সভায় সহযোগিতা করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর), স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং কানাডার সিককিডস।


এই গবেষণায় আর্থিক সহায়তা দিয়েছে কানাডার ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার।


আইসিডিডিআর,বি’র আয়োজিত এই সেমিনারে ওম্যান রাইজ' গবেষণার মূল ফলাফল এবং নীতিগত সুপারিশ নিয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও নীতিনির্ধারকরা আলোচনায় অংশ নেন।


ডা. সোহানা শফিকের নেতৃত্বে পরিচালিত 'ওম্যান রাইজ' গবেষণাটি মহামারির আগে, চলাকালীন এবং পুনরুদ্ধারের সময় বস্তি ও কারখানায় কর্মরত নারীদের অভিজ্ঞতা গভীরভাবে অনুসন্ধান করেছে।


ঢাকা ও গাজীপুরে আইসিডিডিআর,বি’র আরবান হেলথ অ্যান্ড ডেমোগ্রাফিক সারভেইল্যান্স সিস্টেম সাইট এবং গাজীপুরের ছয়টি তৈরি পোশাক কারখানায় এই গবেষণা চালানো হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল, সীমিত সম্পদের শহুরে পরিবেশে জেন্ডার, কর্মসংস্থান এবং স্বাস্থ্যের পারস্পরিক প্রভাব বোঝা। মহামারি প্রতিরোধের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য একটি বিশেষ কৌশল তৈরি ও তার কার্যকারিতা মূল্যায়নে সিস্টেম থিংকিং এবং জেন্ডার-সংবেদনশীল পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে।


অনুষ্ঠানের শুরুতে আইসিডিডিআর,বি’র নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ স্বাগত বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, এই গবেষণার ফলাফল আমাদের সবাইকে ভবিষ্যতের যেকোনো মহামারির জন্য প্রস্তুতি নিতে সহায়তা করবে। আমাদের সতর্ক হওয়া উচিৎ, কারণ কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা আবারও বাড়ছে। তবে এটি আমাদের চলমান কাজগুলোকে আরও পরিশুদ্ধ ও সমৃদ্ধ করারও একটি সুযোগ।’


এরপর ড. সোহানা গবেষণার মূল দিকগুলো তুলে ধরেন। তিনি দেখান, কীভাবে কোভিড-১৯ মহামারিতে বস্তি ও কারখানায় কর্মরত নারীরা বিশেষভাবে ঝুঁকিতে পড়েছিলেন এবং শহুরে স্বাস্থ্যসেবায় কী ধরনের ফাঁকফোকর ছিল। পাশাপাশি, গবেষণার মাধ্যমে প্রয়োগ করা বিশেষ উদ্যোগগুলো কীভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, তাও তিনি বিস্তারিত জানান।


আরও পড়ুন: আইসিডিডিআর,বি’র গবেষণায় ডেঙ্গুর নতুন ধরন, পরিস্থিতি লাগামহীনতার শঙ্কা


মহামারির কারণে নারী-পুরুষ উভয়ের স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মাতৃ, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য, পুষ্টি, মানসিক স্বাস্থ্য এবং সামগ্রিক সুস্থতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেমন, মিরপুর বস্তির এক ২৬ বছর বয়সী গৃহকর্মী জানান, মহামারির সময় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে খরচের চাপে তাকে কানের দুল বিক্রি করতে হয়েছে এবং ঋণ নিতে হয়েছে, যার ফলে তার মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে।


এর পরোক্ষ প্রভাব হিসেবে কর্মসংস্থান কমেছে এবং খাদ্য ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে।


উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ৯০%-এরও বেশি কর্মজীবী নারী অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, যা মহামারিতে সবচেয়ে বেশ ক্ষতির শিকার হয়েছে।


গবেষণায় দেখা গেছে, সুনির্দিষ্ট হস্তক্ষেপের ফলে বেশ কিছু ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি এসেছে। শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের বিস্তার পথ সম্পর্কে জ্ঞান সামগ্রিকভাবে ২৯.৫৯% বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের মধ্যে ৩৬.২৮%। লক্ষণ সম্পর্কে সচেতনতা সার্বিকভাবে ২৪.৭১% বেড়েছে, যেখানে অনুষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের মধ্যে ৩১.৬১% এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের মধ্যে ১৯.৬০% বৃদ্ধি দেখা গেছে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান সামগ্রিকভাবে ২১.২৪% বৃদ্ধি পেয়েছে; এতে আনুষ্ঠানিক খাতের ১৮.২৫% এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের ২৩.৪৩% কর্মী উপকৃত হয়েছেন। হাত ধোয়ার সঠিক সময় সম্পর্কে জ্ঞানও আনুষ্ঠানিক খাতের ২৪.৭০% এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের ২৭.৬৬% কর্মীদের মধ্যে বেড়েছে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার অনুশীলনও সামগ্রিকভাবে ১৫.৯৫% উন্নতি হয়েছে, যা আনুষ্ঠানিক খাতের ১৬.৯৭% এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের ১৫.৪১% উভয় ক্ষেত্রেই দৃশ্যমান। কর্মজীবী নারীদের মধ্যে খাদ্যের বৈচিত্র্য সামগ্রিকভাবে ১১.৫৮% বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে আনুষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের মধ্যে এটি বৃদ্ধি পেয়েছে।


আরও পড়ুন:


এছাড়াও, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী নিবন্ধন সম্পর্কে অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের জ্ঞান ১৬.২৬% বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা পরিষেবা সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে ২৩.৪৩% জ্ঞান বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আনুষ্ঠানিক খাতের ১৫.৫০% এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের ২৮.৫১% কর্মীদের মধ্যেই দেখা যায়।


এছাড়াও, অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চিকিৎসা শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের মাননীয় অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী এবং মহিলা বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য ও জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্রের সিনিয়র ফ্যাকাল্টি ড. হালিদা হানুম আখতার।


মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি অনুরোধ করব এই গবেষণার ফলাফল নীতিনির্ধারকদের কাছে পাঠানোর জন্য, যাতে আমরা আমাদের উদ্যোগগুলোর যথাযথ পর্যালোচনা করতে পারি। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে সহযোগিতায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যাতে আমরা পুরো সিস্টেমকে আরও উন্নত করতে পারি।'


আইসিডিডিআর,বি’র হেলথ সিস্টেমস অ্যান্ড পপুলেশন স্টাডিজ বিভাগের সিনিয়র ডিরেক্টর ড. সারাহ স্যালওয়ে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। আইইডিসিআর-এর পরিচালক এবং এই গবেষণার সহ-প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. তাহমিনা শিরিন সমাপনী বক্তব্যে ভবিষ্যতের মহামারি মোকাবিলায় প্রমাণ-ভিত্তিক ও সহযোগিতামূলক পদ্ধতির গুরুত্ব তুলে ধরেন।


এছাড়াও, সরকারি অংশীজনদের সক্ষমতা বাড়ানো এবং শহরের দরিদ্র কর্মজীবী নারীদের জন্য সামাজিক সুরক্ষার পরিধি বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন