বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে মহানগরে ১৭১টি পুকুরে থাকলেও যার অধিকাংশই সংরক্ষণের অভাবে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। পুকুর কমে যাওয়ায় বাড়ছে এ অঞ্চলের তাপমাত্রা, নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর, সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা, যা ভবিষ্যতের জন্য বড় হুমকিস্বরূপ।
পনেরো বছরে হারিয়েছে দুই হাজার পুকুর
৪৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের খুলনা নগরীতে গেল ৩০ বছরে পাকা দালান ও আবাসিক ভবন মোট ভূমির ২৯ ভাগ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩ ভাগে। দ্রুত বর্ধনশীল নগরায়নের বলি হচ্ছে এই অঞ্চলের পুকুর ও জলাভূমি। ব্যক্তিগত পুকুরের পাশাপাশি সরকারি পুকুর ভরাট করেও তৈরি হচ্ছে স্থাপনা।
কেসিসির তথ্য বলছে, গত ১৫ বছরে হারিয়ে গেছে প্রায় দুই হাজার পুকুর অথচ পরিবেশ আইন ২০১০ অনুযায়ী পুকুর ও জলাধার ভরাট করা বেআইনি।
আরও পড়ুন: খুলনায় ফের নগর পরিবহন চালুর উদ্যোগ
তিন দশক আগেও নগরের প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই বড় ছোট দিঘি-পুকুর ছিল, যেগুলো একদিকে মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতো, অন্যদিকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় রাখত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এখন সেসব জলাশয় দখল আর ভরাট হয়ে একের পর এক দালানকোঠা, মার্কেট ও সড়কে রূপ নিয়েছে। অনেক পুকুর ভরাট করে ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে আবাসিক ভবন, হোটেল কিংবা পার্ক। যেমন খানজাহান আলী রোডের তারের পুকুরের জায়গায় গড়ে উঠেছে জাতিসংঘ শিশুপার্ক, গোলকমনি পুকুরের জায়গায় এখন গোলকমনি পার্ক, ফেরিঘাটের পুকুর ভরাট করে তৈরি হয়েছে বাসস্ট্যান্ড।
কচুরিপানা আর আবর্জনায় অবশিষ্ট পুকুর অস্তিত্ব সংকটে
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সবশেষ জরিপ বলছে, বর্তমানে নগরীতে মাত্র ১৭১টি পুকুর রয়েছে। কিন্তু এর বেশিরভাগই কচুরিপানা, আবর্জনা আর অবহেলার কারণে অচল হয়ে আছে। এই যেমন জোড়াকল বাজারের পাশে বগির পুকুর হিসেবে পরিচিত পুকুরটি গত প্রায় ৫ বছর ধরে এমন কচুরিপানায় পূর্ণ। নতুন বাজার বস্তি এলাকার এই পুকুরটি আবর্জনার স্তূপে পরিণত হয়েছে তাও ৫ বছর ধরে। একই অবস্থা তালতলা পুকুরসহ নগরীর অধিকাংশ উন্মুক্ত জলাশয়ে। এসব পুকুরে এক সময়ে নিয়মিত গোসল করা, সাঁতার শেখা, মাছ চাষ সবকিছুই হতো। পুকুরগুলো সংরক্ষণ করে পুনরায় আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার দাবি স্থানীয়দের।
নিরালা এলাকার বাসিন্দা বয়স্ক আশরাফ আলী বলেন, ‘আমরা ছোটবেলায় প্রতিদিন পুকুরে গোসল করতাম, সাঁতার শিখতাম। গরমের দিনে পুকুরপাড়ে বসে হাওয়া খাওয়া ছিল অন্যরকম আনন্দ। এখন সব ভরাট হয়ে গেছে, জলাশয় নেই বললেই চলে।’
খালিশপুরের গৃহিণী রোকেয়া খাতুন বলেন, ‘আগে বাসার পাশের পুকুর থেকে আমরা রান্নার জন্যও পানি ব্যবহার করতাম। এখন সেই পুকুরটিতে আবর্জনা ফেলা হয়, দুর্গন্ধে টেকা যায় না। এতে মশার উপদ্রবও বেড়ে গেছে।’
আরও পড়ুন: এক মণ্ডপেই দুই শতাধিক প্রতিমায় দুর্গোৎসবের প্রস্তুতি
নতুন বাজার এলাকার দোকানদার আমজাদ হোসেন বলেন, ‘বৃষ্টি হলেই এলাকায় হাঁটু পর্যন্ত পানি জমে যায়। আগে কাছের পুকুরে পানি চলে যেত, এখন পুকুর না থাকায় রাস্তাই ড্রেন হয়ে গেছে।’
নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য
পরিবেশবিদরা বলছেন, জলাশয় হারিয়ে যাওয়ায় প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এতে নগরের তাপমাত্রা বাড়ছে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামছে ক্রমেই নিচে। আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী গত ১০ বছর ধরে প্রতি বছর গড়ে এক ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে খুলনায়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়ক মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, ‘জলাশয় সংকুচিত হওয়ায় নগরবাসী ভয়াবহ পরিবেশ সংকটের মুখে পড়ছে। আইন থাকলেও প্রয়োগ না হওয়ায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও পুকুর ভরাট হচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে খুলনা অচিরেই বাসযোগ্যতা হারাবে।’
সীমিত উদ্যোগ
খুলনা সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আবিরুল জব্বার বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে ১৮টি পুকুর সংরক্ষণ ও সৌন্দর্যবর্ধনের পরিকল্পনা নিয়েছি। তবে নগরীর সব জলাশয় একসঙ্গে সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। নাগরিকদের সচেতন হতে হবে।’
এদিকে আইনে নিষিদ্ধ হলেও পুকুর ভরাট হওয়া খুব একটা আটকাতে পারছে না পরিবেশ অধিদপ্তর। খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক পারভেজ আহমেদ বলেন, কোথাও পুকুর ভরাটের খবর পেলেই আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেই। তবে স্বীকার করতেই হবে, বাস্তবে দখল-অবহেলার কারণে অনেক পুকুর হারিয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: ১০৩ কেজি মাংসসহ আটক হরিণ শিকারি
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একটি শহরে বন ও জলাশয় থাকা উচিত অন্তত ২৫ শতাংশ। কিন্তু খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী নগরে বন ও জলাশয় মিলিয়ে আছে ২০ শতাংশেরও কম। এ অবস্থায় আইন প্রয়োগ ও নাগরিক সচেতনতা না বাড়লে জলাশয় আরও দ্রুত হারিয়ে যাবে, যার পরিণতি হবে ভয়াবহ।