প্রায় দুইশ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টে আলোচনার টেবিলে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তান নামে আলাদা দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র।
তবে নানা স্বপ্ন নিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টিতে অনবদ্য ভূমিকা রাখলেও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গের মানুষের মোহভঙ্গ হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। হাজার মাইলের ভৌগোলিক দূরত্ব প্রতীকী রূপ হয়ে দাঁড়ায় পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সব সূচকেই যোজন যোজন ফারাকের। শুরুতেই ধাক্কা আসে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে। পরে ক্রমেই বাড়তে থাকে বঞ্চনা আর বৈষম্য। যদিও জনসংখ্যায় বেশি, তবুও রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, সামাজিক, শিক্ষা, আঞ্চলিক বিনিয়োগ -- সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়াই যেন নিয়তি হয়ে দাঁড়ায় পূর্ব অংশের।
ষাটের দশকের ছাত্রনেতা রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ সময় সংবাদকে বলেন, পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা এমন একটা গোষ্ঠীর কাছে কেন্দ্রীভূত হয়ে গেল, যারা পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবি-দাওয়ার প্রতি কর্ণপাত করেনি।
আরও পড়ুন: মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরেনি আওয়ামী লীগ: সোহেল তাজ
অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ বলেন,
১৯৪৭ সালের পর এখানে কখনোই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া স্থিতিশীল হয়নি। সব সময় ওই গোষ্ঠীটাই সব নিয়ন্ত্রণ করছিল। পূর্ব পাকিস্তানকে তারা একটা উপনিবেশ হিসেবে ধরে নিয়েছিল। এখান থেকে সম্পদ যাবে; কিন্তু কিছুই আর আসবে না।
মুক্তিযুদ্ধা ইশতিয়াক আজিজ উলফাত বলেন, ‘পাট আর চায়ের মাধ্যমে ফরেন কারেন্সি আসতো। কিন্তু তারা সেটার সিংহভাগ নিয়ে যেতো পশ্চিম পাকিস্তানে।’
ভাষা সংগ্রামের হাত ধরে পরে একে একে দানা বাঁধে আইয়ুববিরোধী লড়াই, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ৬ দফা আন্দোলন। আসে ’৬৯-এর উত্তাল গণ-অভ্যুত্থান। ’৭০- এর নির্বাচনে প্রতিফলন ঘটে বাঙালির ঐক্যবদ্ধ স্বপ্নের। বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজনৈতিক বঞ্চনা, গোষ্ঠীকেন্দ্রিক শাসন, গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ আর ব্যালটে গণরায়ের প্রতি পাকিস্তানি শাসকদের অশ্রদ্ধা অনিবার্য করে তোলে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন,
যেখানে আমার গণতান্ত্রিক অধিকারের স্বীকৃতি নেই, সেখানে তো আমি বসে থাকতে পারি না। আর সেখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সূচনা। পাকিস্তানিরা সামরিক হামলা শুরু করে ২৫ মার্চের কালোরাতে। সেখানে অসংখ্য মানুষ নিহত হয়। তখন মুক্তিযুদ্ধ হয়ে ওঠে অনিবার্য।
আরও পড়ুন: ঢাবিতে নতুন উদ্দীপনায় বিজয় র্যালি
ড. আনু মুহাম্মদ বলেন, সে সময় অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল। কিছু সংখ্যক স্বাধীনতাবিরোধী ছাড়া বাকি সবাই কোনো না কোনোভাবে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। সমাজের কোনো অংশ বাদ ছিল না। এ কারণেই এটাকে জনযুদ্ধ বলা হয়।
একাত্তর কীভাবে হয়ে উঠেছিল গণমানুষের যুদ্ধ -- রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা উলফাত নিজের অভিজ্ঞতায় বলেন,
যুদ্ধ করে যখন আমরা বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিতাম, তখন সেখানে মুক্তিযোদ্ধা পেলে আদর-আপ্যায়ন করা হতো। এমনও হয়েছে, কেউ আমাদেরকে খাওয়ানোর কারণে রাজাকাররা পাকিস্তানি বাহিনীকে জানিয়ে দিয়েছে। তখন তারা গিয়ে সেখানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ তখন সবাই যোদ্ধা হয়ে গিয়েছিল।
বাঙালির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে অবশেষে আসে কাঙ্ক্ষিত বিজয়। উত্তাল গণজাগরণের কেন্দ্রভূমি সে দিনের রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সেনা। তবে স্বাধীনতা এলেও এখনো রয়ে গেছে গণমানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে ব্যবধান, তার জানান দেয় নব্বই, চব্বিশের মতো গণ-অভ্যুত্থান, এমনটাই মনে করেন বিশ্লেষকরা। তাই শাসনব্যবস্থা বদলানোর দাবি আজও প্রাসঙ্গিক।
আরও পড়ুন: শেষ পর্যন্ত ন্যায় ও ন্যায্যতাই বিজয়ী হয়: তারেক রহমান
বাঙালির সম্মিলিত প্রয়াস আর সাহসিকতার কাছে হার মেনে সে দিনের রেসকোর্স ময়দান, আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নত হয়েছিল পাকিস্তানি সেনারা। তবে ২৩ বছরের লড়াই-সংগ্রাম আর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যদিয়ে স্বাধীন ভূখণ্ড পেলেও এখনো পুরোপুরি ধরা দেয়নি সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর অর্থনৈতিক মুক্তি। তাইতো বৈষম্য, বঞ্চনা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় এখনো অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে নামতে হয় এ দেশের মানুষকে।
]]>