এআই চাকরি খাবে নাকি বাড়াবে?

২ সপ্তাহ আগে
যত বেশি প্রতিষ্ঠান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে এবং ভাবছে কীভাবে এটি তাদের মুনাফা বাড়াতে পারে, ততই শ্রমিকদের ওপর এর প্রভাব নিয়ে বিতর্ক বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে দেখা যাচ্ছে, শেয়ারবাজারের মূল্য খুব বেড়ে যাচ্ছে, অথচ মোট (অ-কৃষি খাতের) চাকরির সুযোগ কমছে। এ কারণে সংবাদমাধ্যমে এমন ধারণা তৈরি হয়েছে যে, প্রযুক্তির কারণে চাকরি হারানোর ঝুঁকি বাড়ছে।

গণমাধ্যেমে এমন সংবাদ ছাড়া প্রায় কোনো সপ্তাহই পার হয় না—যেখানে বলা হয়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এআই দিয়ে হোয়াইট কলার জব (White-collar jobs বলতে বোঝায়— অফিসভিত্তিক, মানসিক বা প্রশাসনিক ধরণের পেশা, যেখানে শারীরিক শ্রমের চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ বেশি হয়) করাচ্ছে, বিশেষ করে সেসব পদে যেখানে সাধারণত নতুন স্নাতকরা বা কর্মজীবনের নিম্নস্তরের কর্মীরা কাজ করেন।


চলতি মাসের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শ্রম ও পেনশন কমিটি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অটোমেশন প্রায় দশ কোটি চাকরি ধ্বংস করতে পারে।


এ ধরনের আশঙ্কা যারা প্রকাশ করেন তারা নামকরা অর্থনীতিবিদদের কথাও উদ্ধৃত করতে পারেন, যারা মনে করেন এআই বিপ্লব উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে মাঝারি প্রভাব ফেলবে, কিন্তু কর্মসংস্থানের ওপর এর প্রভাব স্পষ্টভাবে নেতিবাচক হবে। কারণ, এটি বহু কাজকে স্বয়ংক্রিয় করে দেবে।


আমরা এই দুই ধারণার সঙ্গেই একমত নই। আমাদের সাম্প্রতিক গবেষণা দেখিয়েছে, বাস্তবতা অনেক বেশি জটিল এবং এত ভয়ঙ্কর নয় যতটা এই হতাশাবাদী ধারনাগুলো বোঝায়। উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে, এআই দুটি ভিন্ন পথে কাজ করতে পারে— এক, পণ্য ও সেবা উৎপাদনের কাজগুলোকে স্বয়ংক্রিয় করা; দুই, নতুন ধারণা বা উদ্ভাবনের উৎপাদন প্রক্রিয়াকেও স্বয়ংক্রিয় করা।


এরিক ব্রিনজলফসন ও তার সহ-লেখকরা যুক্তরাষ্ট্রের এক সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের কাস্টমার সার্ভিস কর্মীদের ওপর ‘জেনারেটিভ এআই’-এর প্রভাব পরীক্ষা করে দেখতে পান— যেসব কর্মী এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছিলেন, তাদের উৎপাদনশীলতা প্রথম মাসেই প্রায় ১৪% বৃদ্ধি পায়। তিন মাস পর প্রায় ২৫% বেশি মাত্রায় পৌঁছে স্থিতিশীল হয়।


আরেকটি গবেষণাতেও দেখা গেছে, বিভিন্ন ধরনের হোয়াইট কলার ((White-collar jobs বলতে বোঝায়— অফিসভিত্তিক, মানসিক বা প্রশাসনিক ধরণের পেশা, যেখানে শারীরিক শ্রমের চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ বেশি হয়) কর্মীদের মধ্যেও উৎপাদনশীলতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে, যারা শুরুতে কম উৎপাদনশীল ছিল, তাদের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে সবচেয়ে বেশি উন্নতি দেখা গেছে—ফলে প্রতিষ্ঠানের ভেতরে অসমতা কমেছে।


মাইক্রো (ক্ষুদ্রস্তর) থেকে ম্যাক্রো (বৃহত্তর) স্তরে গেলে, আমরা (আঘিয়ন ও বুনেল) ২০২৪ সালের এক গবেষণাপত্রে আগামী এক দশকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধির ওপর প্রভাব নির্ধারণের জন্য দুটি পদ্ধতি বিবেচনা করেছি।

প্রথম পদ্ধতিতে এআই বিপ্লবের সঙ্গে অতীতের প্রযুক্তিগত বিপ্লবগুলোর মিল ব্যবহার করা হয়েছে, আর দ্বিতীয় পদ্ধতিটি ড্যারন আসিমোগলুর “কাজভিত্তিক কাঠামো (task-based framework) অনুসরণ করে; যা আমরা বিদ্যমান গবেষণার তথ্যের আলোকে বিশ্লেষণ করেছি।


প্রথম পদ্ধতির ভিত্তিতে আমাদের হিসাব বলছে, এআই বিপ্লব আগামী দশ বছরে প্রতি বছর গড়ে মোট উৎপাদনশীলতা ০.৮ থেকে ১.৩ শতাংশ পয়েন্ট পর্যন্ত বাড়াতে পারে।


অন্যদিকে, আসিমোগলুর টাস্ক বেসড সূত্র ব্যবহার করে, সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোর ওপর আমাদের নিজস্ব বিশ্লেষণ প্রয়োগ করে, আমরা অনুমান করেছি— এআই মোট উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকে প্রতি বছর ০.০৭ থেকে ১.২৪ শতাংশ পয়েন্ট পর্যন্ত বাড়াতে পারে। যার গড় অনুমান ০.৬৮ শতাংশ পয়েন্ট। যা আসিমোগলুর নিজের অনুমান ০.০৭ শতাংশ পয়েন্টের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি।

 

আরও পড়ুন: কর্মী ছাঁটাইয়ের হিড়িক, এআইতেই আস্থা অ্যামাজনের!


তাছাড়া, আমাদের নির্ধারিত গড় অনুমানকে সর্বনিম্ন সীমা হিসেবে দেখা উচিত। কারণ, এতে নতুন উদ্ভাবনের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এআই-এর স্বয়ংক্রিয়তার সম্ভাবনা বিবেচনা করা হয়নি।


অন্যদিকে, আমাদের এই অনুমানে সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধি-বাধাগুলোকেও ধরা হয়নি— বিশেষ করে এআই ভ্যালু চেইনের বিভিন্ন খাতে প্রতিযোগিতার অভাব, যেগুলো ইতোমধ্যেই ডিজিটাল বিপ্লবের শীর্ষস্থনীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।


এখন প্রশ্ন হলো, সামগ্রিক কর্মসংস্থানে এআই প্রভাব কী?


২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সংগৃহীত ফরাসি প্রতিষ্ঠানের তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা দেখিয়েছি— যেসব প্রতিষ্ঠান এআই প্রযুক্তি গ্রহণ করেছে, তাদের মোট কর্মসংস্থান ও বিক্রয় উভয়ই বেড়েছে।


এই ফলাফল সাম্প্রতিক অধিকাংশ গবেষণার সঙ্গেই সঙ্গতিপূর্ণ, যেখানে দেখা গেছে, অটোমেশনের ফলে শ্রমের চাহিদায় ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এটি এই ধারণাকেও সমর্থন করে যে, এআই গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ব্যবসার পরিধি বাড়িয়ে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হচ্ছে।


এই উৎপাদনশীলতার প্রভাবটি দেখা যাচ্ছে এআই-এর সম্ভাব্য কর্মসংস্থান ধ্বংসের প্রভাবের চেয়েও শক্তিশালী; অর্থাৎ, যেখানে এআই নির্দিষ্ট কিছু পেশা বা কর্মীর কাজ নিজের হাতে নিয়ে নেয়, ফলে শ্রমের চাহিদা কমে যায়।


আমরা দেখতে পেয়েছি, এআই শ্রমের চাহিদায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, এমনকি সেসব পেশাতেও যেগুলো সাধারণত অটোমেশনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত। যেমন— হিসাবরক্ষণ, টেলিমার্কেটিং এবং সেক্রেটারিয়াল কাজ।


তবে এটা সত্য যে, এআই-এর কিছু নির্দিষ্ট প্রয়োগ— যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান বাড়াতে সাহায্য করে। আবার অন্য কিছু প্রয়োগ— যেমন প্রশাসনিক কাজ— সামান্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু এই পার্থক্যগুলো দেখা যায় এআই-এর ব্যবহারের ধরন অনুযায়ী, ক্ষতিগ্রস্ত পেশার প্রকৃতি অনুযায়ী নয়।


সব মিলিয়ে, শ্রমিকদের জন্য প্রধান ঝুঁকি হলো— তারা সরাসরি এআই দ্বারা নয়, বরং এআই ব্যবহারকারী অন্য প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হতে পারে।


ফলে, এআই গ্রহণের গতি কমিয়ে দেওয়া আসলে দেশের কর্মসংস্থানের জন্যই ক্ষতিকর হতে পারে। কারণ, অনেক প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিকভাবে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে, যারা ইতোমধ্যেই এআই ব্যবহার করছে।


আমাদের তথ্য বিশ্লেষণ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, এআই একই সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান— দুটোই এগিয়ে নিতে পারে, তবে এই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়ন করতে হলে উপযুক্ত নীতিগত সংস্কার প্রয়োজন।

উদাহরণস্বরূপ, প্রতিযোগিতা নীতিতে নিশ্চিত করতে হবে যে, শীর্ষস্থানীয় বড় কোম্পানিগুলো নতুন উদ্ভাবক বা ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজারে প্রবেশকে বাধা না দেয়।


আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, এআই গ্রহণ না করা প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে এআই গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত অনেক বড় এবং অধিক উৎপাদনশীল। যা ইঙ্গিত দেয়— যারা ইতিমধ্যেই শীর্ষে আছে, তারাই এআই বিপ্লবের সবচেয়ে বড় বিজয়ী হতে পারে।


বাজারের অতিরিক্ত একচেটিয়া ক্ষমতা ও কেন্দ্রীকরণ এড়াতে, ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এআই ব্যবহার করতে উৎসাহিত করতে হবে। এটা করা সম্ভব প্রতিযোগিতা নীতি এবং শিল্প নীতির মাধ্যমে, যা ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য তথ্য এবং কম্পিউটিং ক্ষমতার সহজ প্রবেশ নিশ্চিত করবে।


এআই-এর কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়াতে এবং শ্রমিকদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব কমাতে, সবাইকে উচ্চমানের শিক্ষার সুযোগ দেয়া, প্রশিক্ষণ দেয়া এবং সক্রিয় শ্রমবাজার নীতি গ্রহণ করা খুবই জরুরি।


পরবর্তী প্রযুক্তিগত বিপ্লব এরইমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। দেশগুলো এবং তাদের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে মানিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা এবং সক্ষমতার ওপর।

 

প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে অনুদিত

লেখক:

ফিলিপ আঘিয়ন: নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ (২০২৫)। কলেজ দ্য ফ্রান্স ও লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সে প্রফেসর এবং Centre for Economic Performance-এ অ্যাসোসিয়েট।

সাইমন বুনেল: Banque de France-এর অর্থনীতিবিদ।

জাভিয়ার জারাভেল: লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সে অর্থনীতির প্রফেসর। 

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন