ঈদ বোনাস: শ্রমিকের পাওনা নাকি মালিকের উপহার, কী বলে ইসলাম?

১ সপ্তাহে আগে
ঈদ—মুসলিম জীবনের সামগ্রিক সুখের মহোৎসব। বছরের পবিত্র দুই ঈদে মুসলিমরা নতুন প্রাণে, নতুন প্রত্যয়ে জেগে ওঠে। ছোট-বড়, ধনী-গরিব বৈষম্যহীনভাবে এক কাতারে দাঁড়ায়। ভালোবাসা বিনিময় করে। অপ্রাপ্তির গল্প ভুলে সম্ভাবনার স্বপ্ন আঁকে।

তাই বছরজুড়ে প্রতিটি মুসলিমপ্রাণই ঈদের দিনের প্রতীক্ষায় প্রহর গোনে। বিশেষ করে চাকরিজীবীদের এই প্রতীক্ষার পাল্লা বেশ ভারী হয়। কারণ, ঈদের মাসে তারা নির্ধারিত বেতনের সঙ্গে ‘বোনাস’ও পান—যে বোনাস তাদের জীবনযাত্রার মানকে কিছুটা ত্বরান্বিত করে। বছরজুড়ে অপূরণীয় থাকা চাহিদাগুলো পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

 

তবে, সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ঈদকে ঘিরে চাকরিজীবীদের প্রতীক্ষাগুলো খুব একটা সুখকর হয় না। কারণ, দেশের বেশিভাগ প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঈদ উপলক্ষে ‘বোনাস’ তো দূরের কথা; বেতনই ঠিকমতো আদায় করা হয় না! ফলে প্রতিবারই রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে দেখা যায় শ্রমিকদের।

 

এদিকে, অনেক প্রতিষ্ঠান আবার বেতন দিলেও ‘বোনাসকে’ হিসাবেই ধরতে চায় না। তাদের ভাষ্য, ‘

 

শ্রমিকের পাওনা হচ্ছে বেতন। আর ‘বোনাস’ মালিকের পক্ষ থেকে স্রেফ একটি উপহার। মালিক চাইলে এটি দেবেন, না দিলে তার কোনো পাপ হবে না।’

 

এখন প্রশ্ন হলো, ‘বোনাস’ কি আসলেই শ্রমিকের পাওনা নাকি মালিকের উপহার? এটি না দিলে পাপ হবে? চলুন, জেনে নিই—

 

সাধারণত বাংলাদেশে চাকরিতে যোগদানের ক্ষেত্রে প্রত্যেক শ্রমিককেই নিয়োগপত্র দেওয়া হয়। শ্রমিক কত টাকা বেতন পাবেন, ধর্মীয় উৎসবের মাসে বেতনের সঙ্গে তাকে কত টাকা ‘বোনাস’ দেওয়া হবে এবং অন্যান্য কী কী সুযোগ-সুবিধা তিনি উপভোগ করতে পারবেন—সব এই নিয়োগপত্রে উল্লেখ থাকে।

 

সুতরাং শ্রমিক যখন থেকে কাজ শুরু করেন, তখন থেকেই তাকে নিয়োগপত্রে উল্লিখিত সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা মালিকের ওপর ওয়াজিব হয়ে যায়। হাদিস শরিফে নবিজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ কর তার ঘাম শুকানোর আগেই’ (বায়হাকি ও মিশকাত)।

 

এই হাদিসের ব্যাখ্যা দিয়ে ফুকাহায়ে কেরাম বলছেন, শ্রমিকের মজুরি দেওয়া যেমন ওয়াজিব; তেমনই ওয়াজিব নিয়োগপত্রে উল্লিখিত ‘বোনাস’ প্রদানও। কারণ, শ্রমিকের সঙ্গে চুক্তি করার মাধ্যমে এটা (বোনাস) আর উপহার থাকে না, বরং নির্ধারিত মজুরির অংশ হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই যারা শ্রমিকের বেতন পরিশোধ করেন কিন্তু ‘বোনাস’ দিতে চান না, তারা প্রতারক হিসেবে গণ্য হবেন। আর ইসলামে প্রতারণাকারীর ঠিকানা জাহান্নাম।

 

রব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘...কেউ ওয়াদা ভঙ্গ করলে তার ওয়াদা ভঙ্গের পরিণাম বর্তাবে তারই ওপর। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে দেওয়া ওয়াদা পূরণ করবে; অচিরেই আল্লাহ তাকে মহা পুরস্কার দেবেন’ (সুরা ফাতহ : ১০)।

 

অন্যের ক্ষতি করে প্রতারক আত্মপ্রবঞ্চনায় ভুগলেও সে মূলত নিজেরই ক্ষতি করে জানিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘তারা আল্লাহ ও মুমিনদের প্রতারিত করে, আসলে তারা নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে প্রতারিত করে না— কিন্তু এটা তারা উপলব্ধি করতে পারে না’ (সুরা বাকারা : ৯)।

 

এ ছাড়া প্রতারকের সঙ্গে মুসলমানদের কোনো সম্পর্ক নেই উল্লেখ করে নবিজি (সা.) বলেছেন, প্রতারক ও ধোঁকাবাজদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই’ (তিরমিজি : ১৩১৫ )।

 

অন্য এক হাদিসে তিনি ( সা.) বলেন, ‘যে আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে, সে আমাদের লোক নয় এবং যে আমাদের প্রতারিত করবে; সে-ও আমাদের লোক নয়’ ( মুসলিম)।

 

নবিজি (সা.) কি বোনাস দিতেন?


বোনাস অর্থ উপঢৌকন-উপহার (কোনো চুক্তিনামা ছাড়া)। আরবিতে এটাকে হাদিয়া বলা হয়। নবিজি (সা.) অধিকাংশ সময় সাহাবিদের হাদিয়া দিতেন। সাহাবায়ে কেরামও নবিজিকে (সা.) উপহার দিতেন। তারা নিজেরাও পারস্পরিক উপহার আদান-প্রদান করতেন।

 

হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা পরস্পরে হাদিয়া বিনিময় কর। এর দ্বারা অন্তরের সংকীর্ণতা ও হিংসা দূর হয়’ (মুসনাদে আহমদ : ৯২৫০, মুসনাদুশ শিহাব: ৬৬০)।

 

অন্য হাদিসে নবিজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা পরস্পর হাদিয়া আদান-প্রদান কর, তাহলে ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে’ (আদাবুল মুফরাদ : ৫৯৪)।

 

বুখারি শরিফে বলা হয়েছে, ‘রাসুল (সা.) উপঢৌকন গ্রহণ করতেন এবং উপহার দাতাকে পুরস্কৃত করতেন’ ( ২৫৮৫)।

 

সালাফদের আমলে ঈদবোনাস


সালাফরাও ঈদবোনাস বা হাদিয়ার আমল করেছেন। ইমাম আবু হানিফা রাহি.-এর উস্তায ইমাম হাম্মাদ বিন আবি সুলায়মান রাহি.-এর জীবনী থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি রমজানে পাঁচশ মানুষকে ইফতার করাতেন। ঈদ উপলক্ষে প্রত্যেককে একটা করে জামা উপহার দিতেন এবং ঈদের পরে প্রত্যেককে একশ দিরহাম করে ঈদবোনাস দিতেন। ( সিয়ারু আলামিন নুবালা : খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ২৩৪)।

 

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও ছড়াকার

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন