ইসলামে শ্রম ও শ্রমিক: মর্যাদা ও অধিকার

৩ সপ্তাহ আগে
মানুষ পরস্পরের উপর নির্ভরশীল সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করলেও সামাজিক অবস্থান সবার এক নয়। কেউ ধনী, কেউ গরীব, কেউ উঁচু, কেউ নীচু, কেউ মালিক কেউ শ্রমিক। এক একজন এক এক বিষয়ে পারদর্শী। ফলে তারা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। আল্লাহর নিকট ধনী-গরীবে কোনো বৈষম্য নেই। মালিক-শ্রমিকের ব্যবধান নেই। বরং সে-ই আল্লাহর কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ, যে তাকওয়া অবলম্বন করে।

সম্পদ, বংশ ও পেশার কারণে মানুষের মর্যাদা নিরূপণ হয় না। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা নিরূপণ হয় নৈতিকতা, নিষ্ঠা ও তাকওয়ার ভিত্তিতে (সূরা হুজুরাত ৪৯/১৩)।
ইসলাম মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ দ্বীন। ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যা মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সুষ্ঠু, যথার্থ ও অত্যন্ত যৌক্তিক সমাধান দিয়েছে। ইসলাম সকল বৈধ পেশাকে উৎসাহিত করেছে এবং সকল পেশার মানুষকে সমান সম্মান দিয়েছে।

 

কাজেই যে কোন পেশার লোক সম্মানের পাত্র। কেননা সমাজ জীবনে আমরা বিভিন্ন পেশার লোকের মুখাপেক্ষী হই। এমনকি শ্রমিক-মজুর, দাস-দাসী, শিক্ষক, জেলে, তাঁতী ও ব্যবসায়ী প্রত্যেকেরই সমাজ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। তাই ইসলাম সবাইকে তার জায়গায় সম্মান দিয়েছে, বিশেষ করে শ্রমিকদের বিষয়ে ইসলাম একটি উচ্চ মানসিকতাসম্পন্ন শ্রমনীতির কথা বলেছে, যেখানে শ্রমিকের মানসম্মত জীবন-জীবিকা নিশ্চিত হয়।

 

শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা

 

ইসলাম মানবজীবনের জন্য রহমত। জাহেলি আরবে যখন দাস-দাসী ও গরিব শ্রমিকদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হতো, তখনই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়ে এসেছিলেন মানবতার বার্তা। একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে আবির্ভাব ঘটে ইসলামের। ইসলাম সকল বৈধ শ্রম ও শ্রমিকের ও গৃহকর্মীর মর্যাদা প্রদান করেছে, তাদের অবস্থান বিবেচনা করেছে, তাদের সম্মানিত করেছে এবং ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তাদের অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। পূর্ববর্তী কোনো কোনো সমাজব্যবস্থায় কাজ ও শ্রমের অর্থ ছিল দাসত্ব ও গোলামি। 

 

কোনো কোনো সমাজব্যবস্থায় কাজের অর্থ ছিল হীনতা ও অপদস্থতা। কিন্তু ইসলাম সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে শ্রমজীবী মানুষের সার্বিক অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তাদের সম্মানজনক জীবনের নিশ্চয়তা দিয়েছে। ইসলামি সভ্যতা কর্মজীবী ও শ্রমিক শ্রেণিকে যে মহৎ দৃষ্টিতে বিবেচনা করেছে সে ব্যাপারে শ্রেষ্ঠ সাক্ষ্য হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন। তাঁর জীবনচরিতই ছিল শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের স্বীকৃতি।

 

কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন: "যখন তোমাদের সালাত আদায় হয়ে যায় তখন তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশে লিপ্ত হয়ে যাও। (সsরা জুমুআ- ১০)

 

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শ্রম দিয়ে জীবিকা উপার্জনের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করে বলেন,  "শ্রমজীবির উপার্জনই উৎকৃষ্টতর,যদি সে সৎ উপার্জনশীল হয়। (মুসনাদে আহমাদ: ৮৩৯৩)

 

অপর এক হাদিসে ইরশাদ হচ্ছে, যে ব্যক্তি আপন শ্রমের উপর জীবিকা নির্বাহ করে তার চেয়ে উত্তম আহার আর কেউ করে না। জেনে রাখো, আল্লাহর নবী দাউদ আলাইহিস সালাম আপন শ্রমলব্ধ উপার্জন দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতেন। (সহিহ বুখারি -২০৭২)

 

মানুষ মানুষের কাছে নানান প্রয়োজনে ছুটে যায়। কেউ শ্রম দেয় অর্থের জন্য, কেউ অর্থ দেয় শ্রম নেওয়ার জন্য। এই প্রয়োজন দ্বিপাক্ষিক হলেও অর্থের প্রয়োজন শ্রমিককে সমাজের চোখে ছোট করে তোলে। এই ছোট ভাবনাটাই শ্রমিককে অবহেলা ও নিগ্রহের মুখে ঠেলে দেয়। ইসলাম এসে এ ধারণাকে বিলুপ্ত করে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা দেন-

 

তোমাদের সেবকেরা তোমাদের ভাই। তাদেরকে আল্লাহ তোমাদের অধীন করেছেন। কারও অধীনে কোনো ভাই থাকলে সে যা খায় তাকেও যেন তা খাওয়ায়, সে যা পরিধান করে তাকেও যেন তা পরায়। তোমরা তাদের ওপর কষ্টকর কাজ চাপিয়ে দিয়ো না। যদি দিতেই হয়, তাহলে তাদেরকে সহযোগিতা কর। (বুখারি: ৩০)

 

শুধু এটুকুই নয়, তাদেরকে যথাযথ সম্মান দিতে বলেছেন; ঠিক যেমন মানুষ নিজ সন্তানের সঙ্গে আচরণ করে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
তাদেরকে সন্তানের মতো মর্যাদা দাও (আদর-যত্ন করো)। তোমরা যা খাও তাদেরকেও তা খাওয়াও। (সুনানে ইবনে মাজাহ-৩৬৯১)

 

আরও পড়ুন: হজরত আলী (রা.)-এর বিচক্ষণতা

 

চাকরবাকর, গৃহকর্মী ও শ্রমিকের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের বিষয়ে কঠোর শাস্তির কথা বলে গিয়েছেন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, হজরত আবু মাসউদ আনাসারী রা. বলেন, আমি একদিন গোলামকে মারছিলাম। পেছনে কাউকে বলতে শুনলাম, মনে রেখো আবু মাসউদ, আল্লাহর ক্ষমতা তোমার ওপর এর চেয়েও বেশি।

পেছনে ফিরে দেখি, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে। বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, সে আল্লাহর ওয়াস্তে আযাদ। নবীজী বললেন, তুমি যদি তা না করতে তবে জাহান্নামের আগুন তোমাকে স্পর্শ করত। (মুসলিম-১৬৫৯)

 

শ্রমিকের দায়িত্ব

 

কারও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় তার উপর অর্পিত দায়িত্ব আদায়ের পর। অধিকার প্রাপক ও অধিকারদাতা উভয়ের সুসম্পর্ক ও সদিচ্ছার উপর নির্ভর করে অধিকার প্রতিষ্ঠা। শ্রমিক ও মালিক উভয়েরই অধিকার রয়েছে নিজ নিজ প্রাপ্য বুঝে পাওয়ার এবং উভয়কেই দায়িত্বশীল আচরণের নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। শ্রমিক নিজের উপর মালিকের কাজের দায়িত্ব নিয়ে এমন এক নৈতিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। চুক্তি পূর্ণ করার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমরা প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করো। নিশ্চয়ই প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে (সুরা বনী ইসরাঈল ১৭/৩৪)

 

শ্রমিকের দায়িত্ব চুক্তি মোতাবেক মালিকের প্রদত্ত কাজ অত্যন্ত নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সাথে সম্পাদন করা। কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘শ্রমিক হিসাবে সেই ব্যক্তি ভালো, যে শক্তিশালী, বিশ্বস্ত’ (সূরা কাছাছ ২৮/২১৬)। রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল। আর তোমাদের প্রত্যেককে সে দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস-৭১৩৮)

 

শ্রমিকের অধিকার

 

শ্রমিকের অনেকগুলো অধিকার আছে,— উপযুক্ত পারিশ্রমিক, ভালো আচরণ, বিপদে পাশে দাঁড়ানো, ভুল-ত্রুটি মার্জনা ইত্যাদি। সর্বাগ্রে একজন শ্রমিকের সবচেয়ে বড় অধিকার হলো, উপযুক্ত পারিশ্রমিক ও নির্ধারিত প্রাপ্য যথাযথভাবে পরিশোধ। শ্রমিক থেকে শ্রম নেওয়ার পর তার ন্যায্য প্রাপ্য দ্রুত পরিশোদের ব্যাপারে গুরুত্বের সাথে তাকিদ দিয়েছে ইসলাম। শ্রমিকের প্রাপ্য যথাযথভাবে পরিশোধ না করা ভয়াবহ গুনাহ। একজন শ্রমিক গায়ের রক্ত ঘামে পরিণত করে হালাল রুজি উপার্জন করে। চুক্তি অনুযায়ী বেতন-ভাতা তার প্রাপ্য। এই প্রাপ্য পরিপূর্ণভাবে দেওয়ার দায়িত্ব মালিকের। মালিক যদি শ্রমিকের বেতন দিতে গড়িমসি করে; কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তাকে পাকড়াও করবেন।

 

হাদিস শরিফে শ্রমিকের মজুরি নিয়ে টালবাহানা না করে তা দ্রুত পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হাদীস, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

 

তোমরা শ্রমিকদের মজুরি দিয়ে দাও তার ঘাম শুকানোর আগেই। সুনানে ইবনে মাজাহ-২৪৪৩ 

 

শ্রমিককে পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত করার ব্যাপারে হাদীস কুদসিতে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

 

কিয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াবো : এক. ঐ ব্যক্তি যে আমার নামে অঙ্গিকার করে তা ভঙ্গ করেছে। দুই. যে কোনো স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করে সেই মূল্য ভক্ষণ করেছে। আর তিন. যে কোনো শ্রমিকের শ্রম পুরোপুরি গ্রহণ করে তাকে তার মজুরি থেকে বঞ্চিত করেছে। (বুখারি-২২২৭)

 

এ থেকে বোঝা যায়, শ্রমিককে তার চুক্তিকৃত মজুরি থেকে বঞ্চিত করা বা মজুরি নিয়ে টালবাহানা করা কত বড় অন্যায়। যে লোক চাকরবাকর, গৃহকর্মী ও শ্রমিকদের প্রতি জুলুম করে, তার জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ তাআলা তাকে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং কেয়ামতের দিন তিনি তার প্রতিপক্ষ হবেন।

 

শ্রমিককে তার চুক্তিকৃত মজুরি যথাসময়ে পরিশোধ করা যেমন একটি কর্তব্য, তেমনি আরেকটি কর্তব্য হচ্ছে, মজুরির পরিমাণ যুক্তিসঙ্গত হওয়া। মজুরি এমন হওয়া কাম্য, যা দ্বারা একজন শ্রমিকের স্বাভাবিক প্রয়োজন মেটে। শ্রমের সঙ্গে পারিশ্রমিকের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। একজন শ্রমিক টাকার প্রয়োজনেই অন্যের কাজ করেন। তিনি তার শ্রম দিচ্ছেন নিজের ও পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য। তাই কাউকে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগের আগে তার কর্মদক্ষতা যাচাই করতে হবে। এরপর উপযুক্ত পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা শ্রম গ্রহীতার ওপর নৈতিক দায়িত্ব। ইসলামী অর্থনীতিতে ন্যূনতম পারিশ্রমিক প্রত্যেক শ্রমিকের প্রয়োজন অনুসারে নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ প্রত্যেক শ্রমিককে কমপক্ষে এমন মজুরী ও পারিশ্রমিক দিতে হয় যাতে সে তার জীবনধারণের স্বাভাবিক চাহিদা পূরণ করতে পারে।


শ্রমিক তার সর্বোচ্চ কষ্ট, চেষ্টা ও শ্রম ব্যয় করবে, আর বিনিময়ে তাকে অনেক অল্প, অতি নগণ্য পারিশ্রমিক পরিশোধ করবে। ইসলাম এমন কর্মকান্ড কে অবৈধ ঘোষণা করেছে।

 

মে দিবস। তাই চতুর্দিকে শুধু শ্রমিকের অধিকার নিয়েই আওয়াজ-উচ্চারণ। সেই আওয়াজ-উচ্চারণের প্রভাব শ্রমিকের জীবনে কতটুকু তা আমরা প্রতিনিয়তই দেখতে পাই।

 

ইসলাম শুধু একদিনই নয়, তিন শ পয়ষট্টি দিনই চাকর-নফর, শ্রমিক, অধীনস্তদের সঙ্গে এমন কোমল আচরণ করতে বলে। তাই আমরা যারা শ্রমিকের অধিকারকে দিবসে বন্দি করে ফেলি, তাদের উচিত পশ্চিম থেকে চোখ ফিরিয়ে কুরআন-হাদীসে নিবদ্ধ করা; তাহলেই সব সমস্যার সমাধান সুন্দর হয়ে ধরা দেবে।

 

সার্বিক জীবনে ইসলাম যে অনুপম সমাজ ব্যবস্থার পথ বাতলে দেয় এর প্রত্যেকটি যদি স্ব-স্ব স্থানে, পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রতিষ্ঠা করা যায় তবে এমন এক বৈষম্যহীন সামাজিক- রীতির উদ্ভব হবে যাতে অধিকার কেড়ে নেওয়া শোষক শ্রেণী, থাকবে না লাঞ্ছিত, অধিকার বঞ্চিত ভূখা-নাঙ্গা শ্রেণী।প্রতিষ্ঠা হবে মালিক শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার। ইসলাম চাকরবাকর, গৃহকর্মী ও শ্রমিকদের সব ধরনের অধিকারের শিকড় প্রোথিত করে দিয়েছে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম কথায় ও কাজের মাধ্যমে এসব অধিকার বাস্তবায়ন করেছেন। তা ছিল এমন এক যুগে যখন মানুষ শ্রমিক, গৃহকর্মী ও ভৃত্যদের প্রতি দুর্ব্যবহার জুলুম অত্যাচার করা ছাড়া আর কিছুই জানতো না। রসুলের জীবনচরিত ছিলো শ্রমজীবী, পেশাজীবী ও শোষিত মানুষের অধিকারের স্বীকৃতি।

 

লেখক: শিক্ষক, প্রাবন্ধিক
 

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন