এমনকি অনেকে এই খবর শুনে মুখ লুকিয়ে থাকত, সমাজে মুখ দেখাতে লজ্জা পেত, আত্মীয়-পরিজনের সামনে দাঁড়াতেও সংকোচ বোধ করত। আরও মর্মান্তিক বিষয় হলো, এই লজ্জা ও সামাজিক অপমান থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অনেক পিতা নির্মমভাবে তাদের কন্যা সন্তানদের জীবন্ত কবর দিত। নিষ্পাপ ছোট্ট সন্তানটি বাবার মুখের দিকে চেয়ে থাকত, অথচ সেই মুখই হয়ে উঠত তার কবরের ফাঁদ।
এ ছিল মানবতার জন্য এক অন্ধকার যুগ, যেখানে নারী ছিল অবহেলিত, নিগৃহীত এবং অধিকার হারা বঞ্চিত এক জাতি। তাদের ছিল না শিক্ষা অর্জনের অধিকার, ছিল না মত প্রকাশের স্বাধীনতা, এমনকি নিজ জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগও ছিল না। তারা ছিল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এক নিষ্পেষিত গোষ্ঠী, যাদের জীবন কেবলই নির্যাতন ও অবহেলার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হতো। যেমনটা পবিত্র কুরআন আমাদের জানান দিচ্ছে,
আর যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয়; তখন তার চেহারা কালো হয়ে যায়। আর সে থাকে রাগান্বিত এবং তাকে যে সুসংবাদ দেওয়া হয়, তার গ্লানির কারণে সে নিজ সম্প্রদায় হতে আত্মগোপন করে। সে চিন্তা করে অপমান সত্বেও কি মেয়ে শিশুকে রেখে দেবে, নাকি মাটিতে পুঁতে ফেলবে! সাবধান! তারা যা সিদ্ধান্ত করে তা কত নিকৃষ্ট!। (সুরা নাহল: ৫৮-৫৯)
তখনকার মানুষের বিবেক ও মানবতা এতটাই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল যে, তারা ‘মেয়ের বাবা আসছে’ এই স্বাভাবিক বাক্যটি শুনতেও লজ্জা পেত, অপমানবোধ করত। অথচ ‘মেয়ে হত্যাকারী বাবা আসছে’ এটা শুনলে যেন তাদের মনে স্বস্তির ছায়া নেমে আসত। এমন ভয়ংকর মানসিকতা গড়ে উঠেছিল সমাজে, যেখানে কন্যা সন্তানকে হত্যা করা লজ্জা ঢাকার উপায় বলে মনে করা হতো।
একটুকরো নিষ্পাপ প্রাণকে মাটির নিচে চাপা দিয়ে তারা মনে করত, তারা সমাজে নিজের সম্মান রক্ষা করেছে। এই নির্মমতার মধ্য দিয়েই যেন তারা নিজেদের পৌরুষ প্রমাণ করত, নিজেদের মান-ইজ্জত বাঁচানোর নামে তারা মেরে ফেলত ভবিষ্যতের মা, বোন, স্ত্রী কিংবা কন্যাকে।
আরও পড়ুন: হজের পরিচিতি ও প্রকারভেদ
অথচ এই ঘৃণ্য কর্মের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে তাদের মনে কোনো সচেতনতা ছিল না। তারা ভাবত না যে, যার প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে, সেই অবুঝ শিশুর আর্তনাদ একদিন আল্লাহর দরবারে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। তারা কল্পনাও করত না, এই অপরাধের জন্য পরকাল তাদের জন্য কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠবে। সমাজের চোখে তারা তৃপ্ত হলেও, আল্লাহর বিচারে তারা ছিল চরম অপরাধী। আর তাদের এই নির্মমতা ছিল মানবতা, মমতা ও করুণার পরিপূর্ণ বিপরীত এক প্রতিচ্ছবি। যেমনটা মহান আল্লাহ তাআলা বলেন,
যখন জীবন্ত প্রোথিতা কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে; কোন অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল?। (সুরা তাকবির: ৮-৯)
মুফাস্সিরগণ বলেন, দয়াময় আল্লাহ তাআলা সেই পাষণ্ড পিতাদের প্রতি এতটাই রাগান্বিত হবেন, যারা কন্যা সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল, যে তিনি তাদের সঙ্গে কোনো কথা বলারও প্রয়োজন মনে করবেন না। তিনি এতটাই ক্রুদ্ধ থাকবেন যে, তাদেরকে সামনে এনে জিজ্ঞেসও করবেন না, ‘তোমরা কেন এই নিষ্পাপ প্রাণকে হত্যা করেছিলে?’
বরং কন্যা সন্তানদেরই সামনে ডেকে তাদের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে নেবেন, ‘কোন অপরাধে তোমাকে হত্যা করা হয়েছিল?’ এই প্রশ্নের উত্তরে তাদের নীরব কষ্ট, তাদের চোখের অশ্রু এবং হৃদয়ের আর্তনাদ সাক্ষ্য দেবে। কী ভয়াবহ সেই অবস্থা হবে! সেই নিষ্পাপ কন্যাটি যাকে সমাজের চোখে বোঝা মনে করা হয়েছিল, তাকেই আল্লাহ তাআলা তার সম্মান ফিরিয়ে দেবেন বিচার দিবসে।
আর যারা তাকে হত্যা করেছিল, তাদেরকে আল্লাহর সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়াতে হবে, অথচ তাদের কোনো কথা বলার অধিকার থাকবে না। এই দৃশ্য কল্পনা করলেই হৃদয় কেঁপে ওঠে। আল্লাহর দরবারে সেই ন্যায়বিচারের মুহূর্ত হবে অত্যন্ত ভয়ানক, যেখানে কোনো মিথ্যা বলার সুযোগ থাকবে না, কোনো অজুহাত চলবে না, শুধু সত্যই সামনে আসবে।
কিন্তু আজকের আধুনিক সমাজে এমন বহু নারী আছেন, যারা ইসলামের প্রতি অকারণে বিদ্বেষ পোষণ করেন। ইসলাম ও তার শিক্ষা তাঁদের কাছে অবাঞ্ছিত মনে হয়। তারা ইসলামকে সহ্য করতে পারেন না। ইসলামের নীতি-নৈতিকতা ও বিধানগুলোর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তারা কি কখনো একটু সময় নিয়ে ইসলামপূর্ব জাহেলি সমাজের ইতিহাস অধ্যয়ন করেছেন?
তারা কি ভেবেছেন, যদি ইসলাম না আসত, তবে তাদের বর্তমান মর্যাদা, সম্মান ও অধিকার কল্পনা করতে পারতো? তখন নারীরা ছিল সম্পূর্ণ অবহেলিত, লাঞ্ছিত ও অধিকারহীন এক শ্রেণি। অথচ ইসলামই প্রথম নারীকে একটি সম্মানজনক অবস্থান প্রদান করেছে। কন্যা সন্তানকে দয়ার নিদর্শন বলে ঘোষণা করেছে, নারীর সম্মান রক্ষায় কঠোর বিধান প্রণয়ন করেছে, শিক্ষা, সম্পদ, উত্তরাধিকার, মতামত ও সমাজে অংশগ্রহণের মতো মৌলিক অধিকার তাদের দিয়েছে। ইসলাম নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় যে বিপ্লব এনেছে, তার তুলনা ইতিহাসে বিরল।
একজন নারী ইসলাম অনুযায়ী মা হিসেবে জান্নাতের চাবিকাঠি, স্ত্রী হিসেবে সম্মানের সঙ্গিনী, কন্যা হিসেবে রহমত, আর একজন ব্যক্তি হিসেবেও পূর্ণ মর্যাদা ও অধিকারপ্রাপ্ত। এতসব উপকার, এত সম্মান, এত অধিকার পাওয়ার পরেও যারা ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করে, তাদের এ আচরণ স্পষ্টতই অকৃতজ্ঞতা বা নিমকহারামী ছাড়া কিছুই নয়। তারা যেন নিজের উপকারকারীর বিরুদ্ধেই অবস্থান নেয়। যে ইসলাম তাদের অপমানের অন্ধকার থেকে তুলে এনে মর্যাদার আসনে স্থাপন করেছে, তার বিরুদ্ধেই তারা অবস্থান নেয়। এখন আসুন, আমরা দেখি ইসলাম নারীদের প্রতি কীভাবে সম্মান প্রদর্শন করেছে, কীভাবে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে এবং কোন কোন দিক থেকে তাদের অধিকার নিশ্চিত করেছে।
নারীর মর্যাদা মেয়ে হিসেবে
আল্লাহর রসুল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
যার একটি মেয়ে সন্তান জন্ম নিল, অতঃপর সে তাকে হত্যা করেনি, অবজ্ঞা করেনি এবং ছেলেকে মেয়ের উপর প্রাধান্য দেয়নি। আল্লাহ তাকে এই মেয়ের কারণে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। (মুসনাদে আহমাদ: ১৯৫৭; আবু দাউদ: ৫১৪৬)। অন্যত্র বলেন, ‘যার দুটি মেয়ে সন্তান আছে, অতঃপর সে তাদের উত্তম সাহচর্য দান করল, তারা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দিবে। (ইবনু মাজাহ: ৩৬৭০; মুসনাদে আহমাদ: ৩৪২৪)।
আরেক জায়গায় তিনি বলেন, ‘যার তিনটি মেয়ে সন্তান আছে এবং সে তাদের ব্যাপারে ধৈর্যধারণ করে, তাদেরকে পানাহার করায় ও সাধ্যমতো পোশাকাশাক পরিধান করায়, সেই মেয়েগণ বাবার জন্য জাহান্নাম হতে রক্ষাকারী প্রতিবন্ধক হবে। (ইবনু মাজাহ: ৩৬৬৯)
জাহেলি সমাজে যেসব মেয়েদের জন্ম ছিল লজ্জা ও অপমানের কারণ, যাদেরকে পরিবার ও সমাজে বোঝা হিসেবে বিবেচনা করা হতো, ইসলাম এসে সেই মেয়েদের মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি করে দিয়েছে। যারা একসময় লাঞ্ছনার কারণ ছিল, ইসলাম তাদেরকেই জান্নাত লাভের মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা করেছে, আলহামদুল্লাহ।
আরও পড়ুন: ভ্রমণে নিরাপদ থাকার দোয়া
নারীর মর্যাদা বোন হিসেবে
রসুল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আমার উম্মতের যে কেউ তিনটি মেয়ে অথবা তিনটি বোন প্রতিপালন করবে এবং তাদের সাথে উত্তম আচরণ করবে, তারা তার জন্য জাহান্নাম হতে রক্ষাকারী প্রতিবন্ধক হবে। (জামে সগির: ৭৫৭২)
নারীর মর্যাদা স্ত্রী হিসেবে
পুরুষদের আদেশ দেওয়া হয়েছে স্ত্রীদের মোহর আদায় করতে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে স্ত্রীদের মোহর আদায় করে দাও...’ (সুরা নিসা: ৪)
ইসলাম আগমনের পূর্বে নারীদের মানুষ হিসেবেই গণ্য করা হতো না। তারা ছিল সম্পত্তির মতো, যাকে ইচ্ছা ব্যবহার করা হতো। কোনো সম্মান, অধিকার বা মর্যাদা ছিল না তাদের জীবনে। অথচ ইসলাম এসে নারীদের সেই অপমানজনক অবস্থা থেকে উদ্ধার করে তাদেরকে সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার দিয়ে মানুষের মর্যাদার শ্রেষ্ঠ আসনে বসিয়েছে। ইসলাম এমনকি বিয়ের সময় একজন নারীর জন্য মোহর নির্ধারণ করে দিয়েছে, যা স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে দেয়া একটি নির্দিষ্ট অর্থ বা সম্পদ। এটি কোনো করুণা নয়, এটি নারীকে দেয়া একটি সম্মানজনক অধিকার।
এই মোহরের মাধ্যমে ইসলাম স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, নারী কোনো পণ্য নয়, বরং সমাজে তার মূল্য ও মর্যাদা রয়েছে, তাকে সম্মান জানিয়ে তার ইচ্ছার ভিত্তিতে বিবাহ সম্পন্ন করতে হবে। অপরদিকে, যারা নারী-পুরুষ সমতার কথা বলেন, তারা কি এতটুকু ন্যায়বোধ দেখাতে পারেন যে, তারা এই দাবিও উত্থাপন করবেন, ‘এখন থেকে নারীরাও স্বামীকে মোহর প্রদান করবে’? তারা কি বলতে পারবেন,
যেহেতু সবকিছুতে সমান অধিকার চাই, সেহেতু বিয়ের সময় মোহরও পুরুষের পাওনা হওয়া উচিত? না, তারা সেটা বলেন না। কারণ ইসলাম যেখানে নারীদের জন্য কিছু সুবিধা নির্ধারণ করেছে, সেটা দেখে তারা চুপ থাকেন বা বিরুদ্ধাচরণ করেন না। সমতা দাবির স্লোগান সেখানে চলে না। এটি প্রমাণ করে, তাদের ‘সমান অধিকার’ দাবিটি পক্ষপাতদুষ্ট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অনেকাংশে ভণ্ডামিপূর্ণ। ইসলাম নারীদের শুধু সমান অধিকার দেয়নি, বরং প্রাকৃতিক পার্থক্য ও সামাজিক ভারসাম্যের আলোকে ন্যয়সঙ্গত, মর্যাদাপূর্ণ ও ন্যায্য অধিকার দিয়েছে, যেখানে নারী লাঞ্ছিত নয়, বরং স্নেহ, সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র।
মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন,
তোমরা স্ত্রীদের সাথে উত্তম আচরণ করো। (সুরা নিসা: ১৯)। আল্লাহর রসুল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম। আর আমি (নবী) আমার স্ত্রীদের কাছে উত্তম। (ইবনু মাজাহ: ১৯৭৭)। অন্যত্র বলেন, ‘চরিত্রের দিক দিয়ে যে ভালো সেই ইমানের দিক দিয়ে পূর্ণ মুমিন। আর উত্তম স্বামী তারা, যারা স্ত্রীদের কাছে উত্তম। (তিরমিজি: ১১৬২)
স্ত্রী হিসেবে নারীর যে অনন্য মর্যাদা ইসলাম দিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করাই নারীর প্রকৃত সম্মান ও অধিকার নিশ্চিত করার পথ। ইসলাম শুধু মুখের বুলি নয়, বাস্তব জীবনে নারীর স্বার্থ রক্ষা ও মর্যাদা প্রদানের জন্য সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছে। ইসলাম একজন স্ত্রীকে কেবল স্বামীর সঙ্গিনীই মনে করেনি, বরং তার হৃদয়ের প্রশান্তি, জীবনের সহচর এবং একটি পরিবারের মূল স্তম্ভ হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন,
আর তার নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত হলো, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকেই জীবনসঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন, যেন তোমরা তাদের মধ্যে প্রশান্তি পাও, আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা রূম: ২১)।
এ আয়াতে নারীকে জীবনের শান্তির উৎস এবং ভালোবাসা ও দয়ার কেন্দ্র হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। আজকের তথাকথিত আধুনিক সভ্যতা যেখানে নারীর স্বাধীনতার নামে তাকে ভোগ্যবস্তুতে পরিণত করেছে, ইসলাম সেখানে স্ত্রীকে দিয়েছে সম্মান, নিরাপত্তা ও অধিকার, যা শুধু কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠার উপযুক্ত পদ্ধতিও ইসলামে নির্ধারিত। সুতরাং একজন নারী যখন স্ত্রী হিসেবে ইসলামের নির্ধারিত মর্যাদা ও অবস্থান গ্রহণ করেন, তখন তিনি শুধুমাত্র নিজেকে নয়, গোটা সমাজকেই একটি সুন্দর, ভারসাম্যপূর্ণ এবং শান্তিপূর্ণ কাঠামো উপহার দেন।
নারীর মর্যাদা মা হিসেবে
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, জনৈক সাহাবী আল্লাহর রসুল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মানুষের মাঝে আমার উত্তম ব্যবহার ও সাহচর্য পাওয়ার অধিক হকদার কে?’ আল্লাহর রসুল বললেন, ‘তোমার মা!’ সাহাবী আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারপর কে?’ আল্লাহর রসুল বললেন, ‘তোমার মা!’ সাহাবী ফের আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারপর কে?’ আল্লাহর রসুল বললেন, ‘তোমার মা!’ চতুর্থবার আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারপর কে?’ এবার আল্লাহর রসুল বললেন, ‘তোমার বাবা’। (সহিহ বুখারি: ৫৯৭১)।
জাহিমা নামের এক সাহাবী আল্লাহর রসুল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রসুল! আমি তো যুদ্ধে গমনের ইচ্ছা করেছি, ফলে আপনার পরামর্শ চাই? তখন আল্লাহর রসুল বললেন, ‘তোমার কি মা আছেন? সাহাবী বললেন, ‘জি হ্যা’ এরপর রসুল বললেন, ‘যাও উত্তমভাবে মায়ের খিদমত করো, কারণ জান্নাত তার পদদ্বয়ের কাছে।’ (নাসাঈ: ৩১০৪; মুসনাদে আহমাদ: ১৫৫৩৮)
আধুনিক নারীবাদীরা বারবার নারীর অধিকার, মর্যাদা ও সমতার কথা বলেন। তারা নিজেদেরকে নারীর একমাত্র অভিভাবক ও অধিকার রক্ষাকারী বলে দাবি করে থাকেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই নারীবাদীগোষ্ঠী কি কখনো মমতাময়ী মায়ের জন্য এমন কোনো সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে, যা ইসলাম দিয়েছে? অন্ততপক্ষে ইসলামের ধারেকাছে যেতে পারে এমন সম্মানের পথ কি দেখাতে পেরেছে? এর স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন উত্তর হবে, না।
উল্টো আধুনিক নারীবাদীরা আজ এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, যেখানে নারীর সম্মানজনক অবস্থানকে নিচে নামিয়ে তাকে ‘পতিতাবৃত্তি’র মতো এক অসম্মান ও ইজ্জতহানীকর পেশায় নিযুক্ত করার দাবি তোলে। তারা এটিকে ‘পেশা’, ‘পছন্দের অধিকার’ বা ‘দেহের স্বাধীনতা’ বলে সাজাতে চায়।
আরও পড়ুন: বিশ্বের প্রথম মুসলিম দেশ হিসেবে তামাক নিষিদ্ধের ঘোষণা মালদ্বীপের
অথচ প্রকৃতপক্ষে এটি নারীকে তার প্রকৃত মর্যাদা থেকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়ার আরেক নাম। এই বিকৃত মতাদর্শ নারীদের সুন্দর সামাজিক কাঠামো থেকে সরিয়ে নিকৃষ্টতম ও জঘন্যতম কর্মপন্থার দিকে আহ্বান জানায়, যেখানে নারীর শরীর হয়ে ওঠে ভোগ্যপণ্য, তার আত্মমর্যাদা ভেঙে চুরমার করে দেয় সমাজ ও সভ্যতার নামে প্রতিষ্ঠিত এক ছদ্মবেশী ব্যবস্থায়। আসলে তারা ‘স্বাধীনতা’র নামে নারীকে পুরুষতান্ত্রিক ভোগের উপকরণে পরিণত করে, অথচ মুখে বলে ‘সমতা’। ইসলামে যেখানে নারীর দেহ, মর্যাদা ও সম্মানকে রক্ষা করা ফরজ করা হয়েছে, সেখানে তারা এসবকে বিক্রি করার অধিকারকে নারীর প্রগতির লক্ষণ বলে দাবি করে। সত্যি বলতে, এটি নারীর প্রকৃত উন্নয়ন নয়, বরং এক ভয়ংকর পতনের নাম। একজন নারীর জন্য সবচেয়ে বড় সম্মান হলো, তার আত্মমর্যাদা, চরিত্র ও সামাজিক অবস্থান রক্ষা করে শান্তিপূর্ণ, মর্যাদাপূর্ণ জীবনের পথ তৈরি করা। ইসলাম সেটাই করেছে এবং আজও করে যাচ্ছে।
ইসলাম আগমনের পূর্বে পৈতৃক সম্পত্তিতে নারীদের কোনো অংশই ছিল না। সম্পদের বরাদ্দ শুধুমাত্র পুরুষদেরই দেওয়া হত। কিন্তু ইসলাম এসে এই অবস্থা পরিবর্তন করে নারীদের জন্য পৈতৃক সম্পত্তিতে নির্দিষ্ট অংশ নির্ধারণ করল, যা নারীদের মর্যাদার এক অনন্য আসন প্রদান করে। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন,‘(পৈতৃক সম্পত্তিতে) দুই মেয়ের সমান এক ছেলে পাবে।’ (সুরা নিসা: ১১)।
অর্থাৎ, বাবা মারা গেলে তার সম্পত্তির ভাগ হিসেবে ছেলে যে অংশ পাবে, মেয়েরা তার অর্ধাংশ পাবেন। বাহ্যিকভাবে কিছু মানুষ মনে করতে পারেন, এখানে হয়তো নারীদের সঙ্গে অন্যায় হয়েছে, কিন্তু তাদের জ্ঞাতার্থে বলা উচিত যে, ইসলাম নারীকে একেবারেই ঠকায়নি। বরং ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের অধিকারের পরিমাণ অনেক বেশি। কারণ, যদিও পুরুষরা বেশি সম্পদ পায়, কিন্তু তাদের ওপর অনেক বেশি দায়িত্ব চাপা থাকে। যেমন, নারী যখন মেয়ে, তখন তার সকল খরচ ও পরিচর্যার দায়ভার থাকে বাবার ওপর; বোন হিসেবে ভাইয়ের ওপর; স্ত্রী হিসেবে স্বামীর ওপর; আর মা হিসেবে সন্তানদের ওপর।
ফলে নারীর অর্থনৈতিক দায়িত্ব পুরুষের তুলনায় অনেক কম। সুতরাং, নারীর হাতে কম সম্পদ আসলেও তার ব্যয়ের খাতের দিক থেকে বিবেচনা করলে সে তেমন কোনো সমস্যায় পড়ত না। তারপরও, দয়াময় আল্লাহ নারীদের সম্মানের জন্য তাদের নিজস্ব সম্পদ ও অর্থ পেতে সুযোগ দিয়েছেন। এটাই ইসলামের এক অনন্য সৌন্দর্য ও প্রগাঢ় ন্যায়বিচার। মোটকথা, ইসলাম নারীদেরকে সমাজে সম্মানের আসনে বসিয়েছে, তাদের অধিকার সুরক্ষিত করেছে এবং সামগ্রিকভাবে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে। এখন প্রশ্ন থেকে যায়, নারীগণ কি সেই সম্মান ও মর্যাদা ধরে রাখতে পারবে?
মোট কথা, ইসলাম নারীকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে এবং তাকে সন্মান ও মর্যাদার এক অনন্য আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তবে একই সঙ্গে, কোনো কোনো নারী যদি তার দায়িত্ব ও নৈতিকতা থেকে বিচ্যুত হয়ে অপকর্মে লিপ্ত হয়, তখন তাকে পুরুষ জাতির জন্য ক্ষতির কারণ হিসেবেও উল্লেখ করেছে।
কারণ নারী জাতি যতদিন সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও দায়িত্বশীল থাকবে, ততদিন তার মাধ্যমে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ উপকৃত হবে। কিন্তু সেই নারী-ই যদি নষ্ট ও ভ্রষ্ট হয়ে যায়, তবে তার প্রভাব কেবল তার নিজের ওপর নয়, পুরো পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রের জন্যও ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমি আমার মৃত্যুর পর পুরুষদের জন্য নারী অপেক্ষা অধিক ক্ষতিকর কোনো ফিতনা রেখে যাইনি।’ (সহিহ বুখারি: ৫০৯৬)
অতএব, নারী পুরুষদের জন্য যেমন উপকারী, তেমনি কখনো কখনো ক্ষতিকরও হতে পারে। এজন্যই ইসলাম নারীদের নিরাপত্তা, সুশৃঙ্খল জীবন ও নৈতিকতা রক্ষায় অত্যন্ত কঠোর নিয়মাবলি আরোপ করেছে। এই কঠোরতা নারীর সুরক্ষা এবং সামাজিক শান্তি বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অনেকেই ইসলামের এই কঠোরতা ও নৈতিক নির্দেশনাকে নারীর স্বাধীনতার পথে বাঁধা বলে মিথ্যা ধারণা সৃষ্টি করতে চেষ্টা করে। এই ধরনের ব্যাখ্যা তাদের স্বল্পবুদ্ধি ও অসচেতনতার পরিচায়ক। ইসলামের নির্দেশনার মূল উদ্দেশ্য হলো নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য সুরক্ষা, সম্মান ও শান্তিপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করা, যা প্রকৃত অর্থে নারীর মুক্তির পথপ্রদর্শক।
লেখক: শিক্ষক, জামিয়া আরাবিয়া কাসেমুল উলুম, ঢাকা।

১ দিন আগে
১








Bengali (BD) ·
English (US) ·