ইসরাইলের নতুন যুদ্ধক্ষেত্র লেবানন

৪ সপ্তাহ আগে
ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডে গত বছরের অক্টোবরে ইসরাইলি হামলা শুরু হওয়ার পর থেকেই লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরাইলের উত্তেজনা চলছিল। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে সেই উত্তেজনা চরমে রূপ নেয়। এক পর্যায়ে ইসরাইলি বাহিনী লেবাননের রাজধানী বৈরুতসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক বিমান হামলা শুরু করে। এর মধ্যেই ১ অক্টোবর লেবাননে স্থল অভিযানে নামে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী।

গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। এতে প্রায় ১ হাজার ১৩৯ জন নিহত হন। এছাড়া দুই শ’য়ের বেশি মানুষকে বন্দি করে গাজায় নিয়ে আসে। এরপর সেদিন থেকেই গাজায় সর্বাত্মক হামলা শুরু করে ইসরাইল। অপরদিকে হামাসের প্রতি সংহতি জানিয়ে ইসরাইলে হামলা চালায় হিজবুল্লাহ। পাল্টা হামলা চালায় ইসরাইলও।

 

চলতি বছরের ২৮ জুলাই ইসরাইল অধিকৃত গোলান মালভূমিতে একটি ফুটবল মাঠে হামলায় ১২ শিশু ও তরুণ নিহত হন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবারও ইসরাইল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এর কয়েক দিন পর বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলে হিজবুল্লাহর কমান্ডার ফুয়াদ শোকর হত্যার শিকার হন। তখন এ হত্যাকাণ্ডকে গোলানে ফুটবল মাঠের ঘটনার পরিণতি বলে উল্লেখ করে ইসরাইল।

 

ফুয়াদ শোকর নিহত হওয়ার পরপরই হামাসের রাজনৈতিক নেতা ইসমাইল হানিয়েও নিহত হন। এই দুই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে অঞ্চলজুড়ে উত্তেজনা তৈরি হয়। ফুয়াদ শোকরের হত্যার বদলা হিসেবে আগস্টের শেষের দিকে রকেট হামলা চালায় হিজবুল্লাহ।

 

১৭ সেপ্টেম্বর লেবাননে হিজবুল্লাহ সদস্যদের ব্যবহৃত কয়েক হাজার পেজার যোগাযোগযন্ত্রে বিস্ফোরণ হয়। এতে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ইসরাইলকে দায়ী করে হিজবুল্লাহ। ইসরাইলের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিশোধের হুমকি দেয় তারা। মূলত ১৭ সেপ্টেম্বর এই পেজার বিস্ফোরণকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়।

 

পেজার বিস্ফোরণের ঘটনায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার হুঁশিয়ারিও দেন হিজবুল্লাহর প্রয়াত প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ। এর মধ্যেই সেপ্টেম্বরের শেষের দিক থেকে রাজধানী বৈরুতসহ লেবাননের বিভিন্ন জায়গায় হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে জোরালো হামলা শুরু করে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী। ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে হিজবুল্লাহর সদর দফতরে চালানো ভয়াবহ হামলায় সংগঠনটির ৩২ বছর ধরে নেতৃত্ব দেয়া হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হন। এরপর ১ অক্টোবর থেকে লেবাননে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে স্থল অভিযান শুরু করে ইসরাইল।

 

আরও পড়ুন: হামাস-হিজবুল্লাহ নেতাদের হত্যার মিশনে ইসরাইল

 

হিজবুল্লাহকে লেবানন থেকে নির্মূল করার ঘোষণা দিয়েছে ইসরাইল। এ জন্য দেশটিতে একের পর এক জোরালো হামলা চালিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। হামলায় নারী–শিশুসহ প্রায় চার হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ১০ লাখের বেশি মানুষ। হামলায় হাসান নাসরুল্লাহসহ হিজবুল্লাহর অনেক শীর্ষ নেতা নিহত হয়েছেন।

 

অপরদিকে হিজবুল্লাহও ইসরাইলে পাল্টা আঘাত হেনেছে। বাননে অভিযানরত ইসরাইলি সেনাসদস্যদের হত্যার পাশাপাশি ইসরাইলের বেশ গভীরে সামরিক ঘাঁটিতে অত্যাধুনিক মিসাইল দিয়ে হামলা চালিয়েছে ইরান সমর্থিত শক্তিশালী সশস্ত্র গোষ্ঠীটি।

 

সেপ্টেম্বর মাস থেকে হিজবুল্লাহর ওপর বড় বড় আঘাত এসেছে। তাদের যোগাযোগ নেটওয়ার্কে ডিভাইস বিস্ফোরণ থেকে শুরু করে হাসান নাসারুল্লাহসহ শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ইসরাইলি বাহিনী হাজার হাজারবার বিমান হামলা করেছে এবং লেবাননে কয়েক হাজার সেনা পাঠিয়েছে।

 

হাসান নাসরুল্লাহর নিহত হওয়ার পর যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল, ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠে হিজবুল্লাহ। সংগঠনটির নতুন প্রধান নাইম কাসেমকে দলের প্রধান নির্বাচিত করার পর হিজবুল্লাহর নেতৃত্ব পর্যায়ে পুনর্গঠন শুরু হয়। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় যেসব কমান্ডার নিহত হয়েছেন, তাদের জায়গায় নতুন কমান্ডার নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

 

এরকম পাল্টাপাল্টি হামলার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের মধ্যস্থতায় গত ২৭ নভেম্বর উভয় পক্ষের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর হয়, যা এখনো বহাল আছে। তবে উভয় পক্ষই একে অপরের ওপর বারবার এই চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ করে আসছে। এমনকি যুদ্ধবিরতি চুক্তির পরও ইসরাইল ও হিজবুল্লাহ পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এতে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে।

 

আরও পড়ুন: গাজায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ, কোথায় গিয়ে থামবে ইসরাইল?

 

যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ৬০ দিনের মধ্যে ইসরাইল দক্ষিণ লেবানন থেকে সম্পূর্ণভাবে সেনা প্রত্যাহার করে নেবে। সেখানে লেবাননের সেনাবাহিনী এবং জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হবে।

 

শর্ত অনুসারে হিজবুল্লাহকেও সীমান্ত থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার উত্তরে লিতানি নদীর উত্তরে তাদের সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করতে হবে এবং দক্ষিণ লেবাননে তাদের সামরিক অবকাঠামো ভেঙে ফেলতে হবে।

 

১১ ডিসেম্বর ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ড (সেন্টকম) জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি চুক্তির অধীনে লেবানন থেকে প্রথম ধাপে সেনা প্রত্যাহার করেছে ইসরাইল। সেখানে লেবাননের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে।

 

এক বিবৃতিতে সেন্টকম বলেছে, সেন্টকমের নেতা জেনারেল এরিক কুরিলা যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে আল-খিয়াম শহর থেকে ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহার এবং সেখানে লেবাননের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের প্রতিস্থাপনের সময় বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণ সদর দফতরে উপস্থিত ছিলেন।

 

কুরিলার উদ্ধৃতি দিয়ে সেন্টকমের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শত্রুতার স্থায়ী অবসান নিশ্চিতে এটি প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সংঘাত বন্ধে এটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।

 

এছাড়া লেবাননের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতি বলেছেন, যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দক্ষিণাঞ্চলে সেনা মোতায়েনের প্রক্রিয়া শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে খিয়াম ও মারজায়ুন এলাকায় সেনা পাঠানোর বিষয়টি ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
 

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন