খ্রিষ্টীয় এস্কেটোলজি বা বাইবেলে উল্লিখিত আর্মাগেডন ও হাদিসে উল্লিখিত মালহামা একই যুদ্ধকে বর্ণনা করে। শেষ জামানায় মানবজাতি সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হবে এই যুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার সময়। মালহামার বহুবচন আল মালাহীম শব্দ দ্বারা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত একাধিক যুদ্ধের সম্মীলনে একটি দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধকে বুঝায়।
হাদিসের আলোকে মালহামা
হাদিসের ভাষ্য থেকে বুঝা যায়, মুসলিম ও খ্রিষ্টানরা সন্ধির মাধ্যমে একজোট হয়ে তৃতীয় একদল শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয় লাভ করবে। সম্মিলিত জোটের বিজয়ের পর একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে জোটে ফাটল সৃষ্টি হবে, মুসলিম ও খ্রিষ্টানরা পৃথক হয়ে পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। এটাকেই হাদিসে আল-মালহামা বা তীব্র রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বলা হয়েছে। এ ঘটনার পূর্ণ বিবরণ সহিহ হাদিসসমূহে বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম ইবনু হিব্বান রাহিমাহুল্লাহ-সহ প্রমুখ মুহাদ্দিস সহিহ সনদে যু-মিখবার রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছি-
ভবিষ্যতে তোমরা রোমানদের (অর্থাৎ খ্রিষ্টানদের) সঙ্গে সন্ধি করবে। এরপর তোমরা ও তারা একত্র হয়ে তোমাদের পশ্চাদ্বর্তী একদল শত্রুর মোকাবেলা করবে। তোমরা তাতে বিজয়ী হবে, গনিমত অর্জন করবে। বিজয়ীবেশে যুদ্ধ থেকে ফিরে আসবে। অবশেষে তোমরা টিলাযুক্ত একটি মাঠে (যাত্রাবিরতির জন্য) অবতরণ করবে। রোমানদের মধ্য থেকে একজন মন্তব্যকারী বলে উঠবে, ক্রুশ বিজয়ী হয়েছে। আর মুসলিমদের মধ্য থেকে একজন মন্তব্যকারী বলে উঠবে, আল্লাহ বিজয়ী হয়েছেন। এরপর মুসলিম ব্যক্তিটি উত্তেজিত হয়ে তাদের ক্রুশের ওপর আক্রমণ করে বসবে, যে ক্রুশটি তার কাছে থাকবে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলবে। এতে রোমানরা উত্তেজিত হয়ে ক্রুশ চূর্ণকারী মুসলিম ব্যক্তির ওপর আক্রমণ করবে। তার গর্দানে আঘাত করে হত্যা করে ফেলবে। এটা দেখে মুসলিমরাও উত্তেজিত হয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নেবে। পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়বে।
আরও পড়ুন: দেশে আশুরার রোজা কবে রাখতে হবে?
এরপর আল্লাহ তাআলা মুসলিমদের এ দলকে শাহাদাতের মর্যাদা দান করবেন। তখন রোমান খ্রিষ্টানরা রোমের বাদশাহকে গিয়ে বলবে, আপনার পক্ষ থেকে আমরা আরবদের (পরাজিত করার) জন্য যথেষ্ট হয়েছি। তারা মালহামা বা তীব্র রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করবে। এরপর তারা আশিটি পতাকাতলে সমবেত হয়ে (চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য) তোমাদের নিকট আগমন করবে। প্রতিটি পতাকাতলে বারো হাজার করে সৈন্য থাকবে। (সহিহু ইবনি হিব্বান: ৬৭০৮, মুসতাদরাকুল হাকিম: ৮২৯৮, তাবারানি: ৪২৩১)
মালহামা বা ভয়ংকর রক্তক্ষয়ী মহাযুদ্ধ কখন শুরু হবে?
এ ব্যাপারে হাদিস থেকে জানা যায়, মালহামা শুরু হওয়ার আগে দুটি বিশেষ ঘটনা ঘটবে। এক. বাইতুল মাকদিস বা জেরুজালেম অঞ্চল আবাদ হবে, সেখানে ব্যাপক জনবসতি গড়ে উঠব, বৈশ্বিক রাজনীতিতে তার গুরুত্ব অনেক বেড়ে যাবে। দুই. মদিনা শহর বিরান হয়ে পড়বে, সেখানে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, বৈশ্বিক রাজনীতিতে তার গুরুত্ব একেবারে কমে যাবে।
এ ব্যাপারে ইমাম আবু দাউদ রহিমাহুল্লাহ-সহ প্রমুখ মুহাদ্দিস সহিহ সনদে মুআয বিন জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
বাইতুল মাকদিসে (অর্থাৎ জেরুজালেমে) বসতি নির্মাণ মদিনা বিপর্যয়ের কারণ হবে, মদিনার বিপর্যয় মালহামা (অর্থাৎ রক্তক্ষয়ী মহাযুদ্ধ) শুরুর কারণ হবে, মালহামার সূচনা কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের কারণ হবে আর কনস্টান্টিনোপলের বিজয় দাজ্জাল আবির্ভাবের কারণ হবে। এরপর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যার নিকট হাদিসটি বর্ণনা করেছেন, তার ঊরুতে বা কাঁধে নিজের হাত দিয়ে মৃদু আঘাত করে বললেন, এটা নিশ্চিত সত্য, যেমন তোমার এখানে থাকাটা অথবা তোমার এখানে বসাটা বাস্তব। অর্থাৎ তিনি মুআয বিন জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহুর ঊরুতে বা কাঁধে মৃদু আঘাত করে কথাটি বলেছেন। (আবু দাউদ: ৪২৯৪, মুসনাদু আহমাদ: ২২১২১, মুসান্নাফু ইবনি আবি শাইবা: ৩৭৪৭৭)
মালহামা কোথায় সংঘটিত হবে?
এ ব্যাপারে হাদিসসমূহের ভাষ্য থেকে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, মালহামা সংঘটিত হবে শাম (বর্তমানের সিরিয়া, জর্ডান, ফিলিস্তিন প্রভৃতি) দেশে। মুসলিমদের অবস্থানস্থল হবে ‘গুতা’, যা দামেশক শহরের নিকটবর্তী একটি অঞ্চলের নাম। ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ-সহ প্রমুখ মুহাদ্দিস সহিহ সনদে আবু দারদা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
إِنَّ فُسْطَاطَ الْمُسْلِمِينَ يَوْمَ الْمَلْحَمَةِ بِالْغُوطَةِ، إِلَى جَانِبِ مَدِينَةٍ يُقَالُ لَهَا: دِمَشْقُ، مِنْ خَيْرِ مَدَائِنِ الشَّامِ মালহামা বা তীব্র রক্তক্ষয়ী মহাযুদ্ধের সময় মুসলিমদের শিবির স্থাপন করা হবে ’গুতা’ অঞ্চলে, যা শামের সর্বোত্তম নগরী দামেশক নামক শহরের পাশে অবস্থিত হবে। (আবু দাউদ: ৪২৯৮, মুসনাদে আহমাদ: ২১৭২৫, তাবারানি: ৫৮৯)
তাবারানি আরেকটি বর্ণনায় উপরিউক্ত হাদিসের শেষ কথাটি এভাবে এসেছে-
فَهِيَ خَيْرُ مَسَاكِنِ النَّاسِ يَوْمَئِذٍ সুতরাং সেসময় দামেশক শহরটি হবে লোকদের জন্য সর্বোত্তম আবাসস্থল। (তাবারানি: ১৩১৩) মুস্তাদরাকে হাকিমের বর্ণনায় উপরিউক্ত হাদিসের শেষোক্ত কথাটি এভাবে এসেছে- خَيْرُ مَنَازِلِ الْمُسْلِمِينَ يَوْمَئِذٍ সেসময় দামেশক শহরটি হবে মুসলিমদের জন্য সর্বোত্তম অবস্থানস্থল। (মুসতাদরাকুল হাকিম: ৮৪৯৬)
আর রোমান খ্রিষ্টানদের মূল অবস্থানস্থল হবে দাবিক বা আমাক অঞ্চলে। এ দুটি হলো শামের হালব শহরের নিকটবর্তী দুটি অঞ্চলের নাম। ইমাম মুসলিম রাহিমাহুল্লাহ-সহ প্রমুখ মুহাদ্দিস আবু হুরাইরা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يَنْزِلَ الرُّومُ بِالْأَعْمَاقِ أَوْ بِدَابِقٍ ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না রোমান খ্রিষ্টানরা আমাক অথবা দাবিক অঞ্চলে (মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য) অবস্থান করবে। (মুসলিম: ২৮৯৭, সহিহ ইবনে হিব্বান: ৬৮১৩)
মালহামা বা মহা যুদ্ধের ফলাফল
সহিহ হাদিসসমূহে মালহামার পূর্ণ বিবরণ ও এর ফলাফল বা শেষ পরিণতি সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। ইমাম মুসলিম রাহিমাহুল্লাহ-সহ প্রমুখ মুহাদ্দিস আবু হুরাইরা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না রোমান খ্রিষ্টানরা আমাক অথবা দাবিক অঞ্চলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অবস্থান করবে। তখন তাদের মোকাবেলায় (দামেশক) শহর থেকে তখনকার সময়ে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ লোকদের একটি বাহিনী বের হয়ে আসবে। সবশেষে তারা যুদ্ধে লিপ্ত হবে। এ যুদ্ধে মুসলিমদের এক-তৃতীয়াংশ সৈন্য পরাস্ত হয়ে পালিয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা কখনো তাদের তওবা গ্রহণ করবেন না। আর তাদের এক-তৃতীয়াংশ নিহত হবে। তারা হবে আল্লাহ তাআলার নিকট সর্বোত্তম শহীদ। আর তাদের অপর তৃতীয়াংশ বিজয় লাভ করবে। তারা আর কখনো ফিতনায় আক্রান্ত হবে না।
এরপর তারা কনস্টান্টিনোপল বিজয় করবে। এরমধ্যেই শয়তান মিথ্যা গুজব রটিয়ে দিবে দাজ্জাল চলে এসেছে। মুসলিমরা দামেশকে ফিরে এসে দেখবে দাজ্জাল চলে এসেছে। মুসলিম বাহিনী যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করবে। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবে। ইতোমধ্যে নামাজের জন্য ইকামত দেওয়া হবে, আর এদিকে ঈসা আলাইহিস সালাম আসমান থেকে ফেরেশতার কাঁধে ভর করে দামেশকের মসজিদের মিনারে অবতরণ করবেন। তিনি মুসলিম বাহিনীর ইমামতি করবেন। আল্লাহ তাআলার শত্রু দাজ্জাল যখন তাকে দেখতে পাবে তখন সে গলে যেতে থাকবে; যেভাবে পানিতে লবণ গলে যায়। যদি ঈসা আলাইহিস সালাম তাকে নিজ হাতে তাকে হত্যা করবেন। তার রক্ত ঈসা আলাইহিস সালাম বর্শাতে করে মানুষকে দেখাবেন। (মুসলিম: ২৮৯৭, ইবনে হিব্বান: ৬৮১৩, মুসতাদরাকুল হাকিম: ৮৪৮৬)
আরও পড়ুন: পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার দোয়া ও আমল
ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ কি মালহামার ইঙ্গিত?
সম্প্রতি ইরান-ইসরাইল উত্তেজনা ও সংঘাত নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করছেন: এটি কি হাদিসে বর্ণিত 'মালহামাতুল কুবরা' বা আর্মাগেডনের সূচনা? সহিহ হাদিস অনুযায়ী, মালহামা হবে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, যেখানে মুসলিম ও খ্রিষ্টানরা প্রথমে মিত্র হয়ে তৃতীয় শত্রুর বিরুদ্ধে লড়বে, পরে পারস্পরিক বিরোধে একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। যুদ্ধটি শাম অঞ্চলে, বিশেষ করে সিরিয়ার 'গুতা', দামেশক, দাবিক ও আমাক এলাকায় সংঘটিত হবে। এর আগে বাইতুল মাকদিসের উত্থান ও মদিনার পতন ঘটবে। যদিও ইরান-ইসরাইল যুদ্ধের মধ্যে হাদিসের পূর্ণ ইঙ্গিত মেলে না, তবে এরকম সংঘর্ষ শেষযুগের বড় যুদ্ধের পথ প্রশস্ত করতে পারে। তাই বর্তমান পরিস্থিতি মালহামার পূর্ণ প্রতিফলন না হলেও এর ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মিল কিছুটা হলেও পাওয়া যায়।