ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু ৩৩ মাস আগে, শেষ কবে?

৩ সপ্তাহ আগে
বিদায় নিচ্ছে ২০২৪। বছরজুড়ে বিশ্বের যেসব বিষয় আলোচনায় ছিল তার মধ্যে অন্যতম ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত। দীর্ঘ ৩৩ মাস চলা এ যুদ্ধ কবে থামবে তা জানা নেই কারও। তবে নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ যুদ্ধের নতুন সমীকরণ দিতে পারেন বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযানের নির্দেশ দিয়েছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এই দীর্ঘ সময়ে দুপক্ষের পাল্টা হামলায় হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ও লক্ষাধিক মানুষের বাস্তুচ্যুতি ঘটেছে। এই যুদ্ধ ১৯৬২ সালের কিউবান মিসাইল ক্রাইসিসের পর মস্কোর সঙ্গে পশ্চিমের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

 

প্রায় তিন বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে ইউক্রেনের দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝিয়া-চারটি প্রদেশের আংশিক দখল নিয়েছে রুশ বাহিনী। এই চার প্রদেশের রাশিয়ার দখলে যাওয়া অংশের সম্মিলিত আয়তন ইউক্রেনের মোট ভূখণ্ডের এক-পঞ্চমাংশ।

 

সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ইউক্রেন যুদ্ধে সমাপ্তি নিয়ে আলোচনার গতি পেয়েছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের পর এই সংঘাতের ইতি হতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। কারণ নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় ট্রম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি প্রেসিডেন্ট হলে ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সমাধান করবেন’। কীভাবে তা করবেন, এ নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা না দিলেও শপথ নেয়ার আগেই যুদ্ধ বন্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ট্রাম্পের কিছু উদ্যোগ দেখা গেছে।

 

যদিও দু’পক্ষের মধ্যে গত কয়েকমাসে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা বেড়েছে। গত মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অনুমোদনের পর প্রথমবারের মতো রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি দূরপাল্লার ‘এটিএসিএমএস’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী।

 

জবাবে রাশিয়া ইউক্রেনের দিনিপ্রো শহরে প্রথমবার তাদের ওরেশনিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এই আক্রমণকে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সরবরাহ করা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার গভীরে ইউক্রেনের হামলার জবাব হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।

 

আরও পড়ুন: যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে নাগরিকদের সতর্ক করলো রাশিয়া

 

সম্প্রতি যুক্তাষ্ট্রের গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, ইউক্রেনকে লক্ষ্য করে ফের আরেকটি পরীক্ষামূলক হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে পারে রাশিয়া। তবে এই ধরনের অস্ত্র দিয়ে হামলা ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধের গতিপথ নির্ধারণ করতে পারবে বলে মনে করে না ওয়াশিংটন।

 

এর আগে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছিলেন, ইউক্রেন যদি দূরপাল্লার পশ্চিমা ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রুশ ভূখণ্ডে আঘাত হানতে থাকে, তাহলে রাশিয়া আবার ওরেশনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে পারে এবং সেটি সম্ভবত কিয়েভের সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রগুলো লক্ষ্য করে।

 

রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধের চুক্তিতে আগ্রহী জেলেনস্কি

 

যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধে ‘চুক্তি’ করতে আগ্রহী ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। ফ্রান্সের প্যারিসে দুজনের বৈঠক শেষে ৮ ডিসেম্বর নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ স্যোশালে তিনি এ কথা বলেন।

 

এর আগে ৭ ডিসেম্বর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে ত্রিপক্ষীয় এ বৈঠকে দেশটির প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ উপস্থিত ছিলেন। এমন সময় ফরাসি প্রেসিডেন্ট এ বৈঠকের আয়োজন করেছেন, যখন রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের অবস্থান নিয়ে সংশয়ে রয়েছে কিয়েভ।

 

ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় যাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই সংঘাতের অবসান ঘটাবেন তিনি। তার এই প্রতিশ্রুতি কিয়েভের উদ্বেগ বাড়িয়েছে। কেননা দেশটি মনে করছে, এটি মূলত মস্কোর শর্তানুযায়ী হতে পারে। আর এমনটি হলে নিজ ভূখণ্ডের কিছু অংশ হয়তো তাদের হারাতে হবে ইউক্রেনকে।

 

দায়িত্ব গ্রহণের আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে কাজ শুরু করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। সংঘাত নিরসনে দুই দেশের সঙ্গে গোপনে ও প্রকাশ্যে আলোচনার উদ্যোগ নিচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপদেষ্টারা।

 

আরও পড়ুন: যুদ্ধে হারার শঙ্কায় জেলেনস্কি, আরও অস্ত্র দিচ্ছে পশ্চিমারা

 

ট্রুথ স্যোশালে ট্রাম্প লেখেন, ‘একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর এবং এই পাগলামি বন্ধের পথ বেছে নেবে জেলেনস্কি ও ইউক্রেন।’ নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ‘অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং আলোচনা শুরু হওয়া উচিত। অপ্রয়োজনে অনেক বেশি প্রাণ ঝরে গেছে, অনেক পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। যদি এভাবে চলতে থাকে, এটি আরও বড় ও খারাপ কিছুতে রূপ নেবে।

 

যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে উল্টো দাবি করেছেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। ওই পোস্টে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, কেবল একটি কাগজের টুকরা এবং কয়েকটি স্বাক্ষরের মাধ্যমে এ সংঘাত বন্ধ করা সম্ভব নয়। ইউক্রেনের বাসিন্দারা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করার আহ্বান জানান তিনি।

 

গত ৭ ডিসেম্বর প্যারিসে ট্রাম্পের সঙ্গে জেলেনেস্কির বৈঠক হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় মস্কো জানিয়েছে, যেকোনো সমঝোতা তখনই সম্ভব হবে যখন ইউক্রেন রাশিয়ার অঞ্চলগুলো থেকে তার বাহিনী প্রত্যাহার করবে।

 

ট্রাম্প-জেলেনস্কির বৈঠকের কয়েক ঘণ্টা পরই নতুন করে প্রায় ১০০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তার ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নেতৃত্বাধীন বর্তমান মার্কিন প্রশাসন। ইউক্রেনের জন্য নতুন এই অস্ত্র সহায়তার মধ্যে রয়েছে ড্রোন, ট্যাংক, সাঁজোয়া যান, হিমার্স রকেট লঞ্চারের গোলাবারুদ এবং আর্টিলারি সিস্টেমের সরঞ্জামসমূহ।

 

এদিকে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের বিষয়ক যেকোনো আলোচনায় ইউক্রেনের নিরাপত্তা গ্যারান্টির প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিতে বলেন ভলোদিমির জেলেনস্কি । 

 

৭ ডিসেম্বরের আলোচনার সঙ্গে পরিচিত দুটি সূত্রের বরাতে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, বৈঠকে ট্রাম্পের সঙ্গে একটি সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন ইউক্রেনের নেতা।

 

আরও পড়ুন: ইউক্রেনে সহায়তা কমানোর ঘোষণার পর ট্রাম্পের প্রশংসায় জেলেনস্কি

 

বৈঠকে ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত অবসানের আলোচনা কীভাবে কার্যকর হতে পারে এ নিয়ে কিছু প্রাথমিক সূত্রের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, যদিও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে আলোচনায় বসানোর প্রক্রিয়াটি জটিল এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এখনও স্পষ্ট নয়।

 

সূত্র জানিয়েছে, সাক্ষাতের সময় ট্রাম্প একটি বন্ধুত্বপূর্ণ, সম্মানজনক ও খোলামেলা আচরণ করেছিলেন। এ সময় কিছু বলার চেয়ে তিনি বরং শুনতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন বলে মনে হয়েছিল।

 

ট্রাম্প কিংবা তার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা যারা ইউক্রেনের সঙ্গে কাজ করছেন, তারা ঠিক কীভাবে যুদ্ধের সমাধানের পরিকল্পনা করছেন এবং যেকোনো মীমাংসার অংশ হিসেবে ইউক্রেনের সুরক্ষা গ্যারান্টির দাবিটিকে দেখছেন এসব বিষয় এখনও স্পষ্ট করেননি।

 

ন্যাটো সামরিক জোটে যোগদানের আমন্ত্রণের জন্য বিদায়ী মার্কিন প্রশাসনকে চাপ দিয়ে আসছে কিয়েভ। দীর্ঘদিন ধরে তারা বলে আসছে, পরবর্তীতে সম্ভাব্য কোনো নতুন রুশ আক্রমণ ঠেকাতে তাদের নিরাপত্তা গ্যারান্টির প্রয়োজন হবে।

 

তবে, ইউক্রেনে শান্তি অর্জনের জন্য মস্কোর সব বাহিনীকে দেশটি থেকে প্রত্যাহার করতে হবে-পূর্বের এমন মনোভাব ছেড়ে জেলেনস্কি সম্প্রতি স্বীকার করেছেন, যুদ্ধের একটি কূটনৈতিক সমাধান জীবন রক্ষা করবে।
 

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন