সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন বিজিবির উর্মি রেস্ট হাউজের সীমান্ত সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিজিবির রামু সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমেদ এ তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে গেছে এবং তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইয়াবা পাচার হয়। তবে বাংলাদেশি যে সমস্ত ব্যবসায়ী আছে বা বাংলাদেশি পাচারকারীরা, অনেক ক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা এই ইয়াবাগুলো মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসে। এখানে আরাকান আর্মি বাংলাদেশিদের হাতে এসে দিয়ে যাচ্ছে এমন কোন ঘটনা নেই। বাংলাদেশি পাচারকারী যারা আছেন স্বার্থান্বেষী যারা আমাদের দেশের ভাল চায় না এরকম অসাধু ব্যক্তিরাই এই ব্যবসাগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত। তারা আরাকান আর্মির কাছ থেকে ইয়াবাগুলো বাংলাদেশে নিয়ে আসে।
কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ট্রলারের পাটাতন, সিএনজির হেডলাইট, শুকনো মরিচ, বেগুন, মানুষের পেঠের ভেতর, আচারের প্যাকেট, আচারের বয়াম, স্যান্ডেলের ফিতা, সাউন্ড বক্স, সুপারির ভেতর, ল্যাপটপ, গাড়ির যন্ত্রাংশ, মোটর সাইকেল কোন কিছুই বাদ নেই ইয়াবা চোরাচালানের জন্য। সীমান্তে নিয়মিত টহলের পাশাপাশি চেকপোস্টেও দায়িত্বপালন করছে বিজিবি। এই চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনকালে এ সমস্ত অভিনব পন্থায় যে ইয়াবাগুলো পাচার হয় সেগুলো ধরতে সক্ষম হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সীমান্ত নিরাপত্তা, অনুপ্রবেশ, মাদক ও চোরাচালান রোধে বিজিবি সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে দায়িত্ব পালন করছে জানিয়ে গত ১৫ জুলাই থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাদকদ্রব্য উদ্ধারের তথ্য অবহিত করা হয়ে।
এই দুই মাসে ২৮ লাখের বেশী ইয়াবা, প্রায় ১ কেজি ক্রিস্টাল মেথ আইস সহ ৮৮ কোটি টাকার বেশি মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে। এই সময়ে সীমান্ত দিয়ে আসা ২২টি দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলিসহ ৫ জনকে আটক করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, যে অস্ত্রগুলো বাংলাদেশে আসছে সেগুলো নিরাপত্তার খাতিরে তার উৎস খোলাসা করছি না। নিরাপত্তার খাতিরে এ তথ্য বিজিবি কাছে থাকছে। তবে অস্ত্রগুলো মিয়ানমার থেকে আসছে এবং এগুলো সাধারণত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দিকে যায়। অস্ত্রের এই যাতায়াত আর যাতে না করে বিজিবি সে ব্যাপারে সোচ্চার রয়েছে এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশের অসংখ্য নৌযান জলসীমা অতিক্রম করে ‘রহস্যজনকভাবে’ মিয়ানমারে অভ্যন্তরে যাতায়ত করছে বলে জানায় বিজিবির সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ।
আরও পড়ুন: বিমানবন্দরে ক্রিকেট ব্যাটে করে ইয়াবা নেয়ার সময় আটক ২ যুবক
তিনি বলেন, সীমান্ত নিরাপত্তায় বিজিবি নতুন পদক্ষেপ নিয়েছে। যে পদক্ষেপে রাডার থেকে তথ্য সংগ্রহ, ড্রোন, নাইট ভিশন ডিভাইস এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এই প্রযুক্তিতে ধরা পড়ছে বাংলাদেশের নৌযান জলসীমা অতিক্রম করে মিয়ানমার যাতায়তের দৃশ্য।
বিজিবির পর্যবেক্ষণের তথ্য দিয়ে জানিয়েছেন, নাফ নদী ও সাগর উপকূলীয় মহেশখালী, কুতুবদিয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা ও কুয়াকাটা এলাকা দিয়ে মাদক চোরাচালানের দুইটি অন্যতম প্রধান পথ তৈরি হয়েছে। যে পথে অধিকাংশ চোরাচালান হচ্ছে। আর ৮০ শতাংশ মাদকই সাগর উপকূলীয় এলাকা দিয়ে চোরাচালানের ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট বিজিবির কাছে রয়েছে। এই রুটগুলো ব্যবহার করে মিয়ানমার থেকে আসা মাদকদ্রব্য শুধু বাংলাদেশে বিস্তার লাভ করছে না, বরং অন্যান্য দেশেও পাচার হয়ে যাচ্ছে। যা আমাদের দেশের যুব সমাজ ও অর্থনীতির জন্য হুমকি স্বরূপ।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে, গত ডিসেম্বর থেকে এই পর্যন্ত সমুদ্র থেকে আরাকান আর্মি হাতে ২২৮ জন জেলে ধরে নিয়ে যাওয়ার তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, আটকদের মধ্যে বিজিবির প্রচেষ্টায় ১২৪ জনকে ফেরত আনা হয়েছে। এখনও ১২ টি ট্রলারসহ ১০৪ জন জেলে আরাকান আর্মির হাতে আটক রয়েছে। যার মধ্যে ৯৫ জন বাংলাদেশি এবং ১৩৩ জন রোহিঙ্গা।
আরও পড়ুন: পালংখালী সীমান্তে ৫০ হাজার ইয়াবাসহ পাচারকারী আটক
তাদের ফেরত আনতে বিজিবির নিজস্ব কৌশলে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে জানিয়ে সেক্টর কমান্ডার বলেন, আরাকান আর্মির সাথে আমাদের অফিশিয়াল কোন যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে না। নানা মাধ্যমে কৌশলে যোগাযোগ করতে গিয়ে একটু বিলম্ব হচ্ছে। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের ফেরত আনা সম্ভব হতে পারে।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ধরে নিয়ে যাওয়া জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমা অতিক্রম করে মিয়ানমারে অনুপ্রবেশের পর আটক হয়েছে। আমাদের জলসীমায় এসে আমাদের জেলেদের ধরে নিয়ে যাওয়ার সাহস কারও নেই।
সাগরপথে মাদক চোরাচালান প্রতিরোধে বিজিবির সক্ষমতা না থাকলেও আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের গোয়েন্দা তথ্য ও ডিজিটাল তথ্য-উপাত্য দিয়ে সাগরে দায়িত্ব পালনকারী বাংলাদেশ নেভি ও কোস্টগার্ডকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিজিবি আভিযানিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি অবৈধ সীমান্ত অতিক্রম, মাইন বিস্ফোরণ, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান প্রতিরোধে সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিতে সীমান্ত এলাকায় জনসচেতনতামূলক সভা, লিফলেট বিতরণ, ও মাইকিং পরিচালনা করা হচ্ছে। জনমত তৈরি ও জেলেদের নাফ নদীতে মাছ ধরার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জলসীমা অতিক্রম না করার জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টিতেও কাজ করে যাচ্ছে বিজিবি। এছাড়া বিজিবি প্রান্তিক জনসাধারণের জন্য চিকিৎসা সহায়তা, মাইন বিস্ফোরণে আহতদের আর্থিক সহায়তা প্রদান ও সীমান্তের যুবসমাজকে মাদকের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নিয়মিত খেলাধুলার আয়োজন করছে।
সংবাদ সম্মেলনে বিজিবির বিভিন্ন ব্যাটালিয়নের অধিনায়করা উপস্থিত ছিলেন।