অস্তিত্ব সংকটে খুলনার ৩৭ নদী, হুমকিতে নৌপথ ও অর্থনীতি

৪ দিন আগে
খুলনা অঞ্চলের অন্তত ৩৭টি নদী অস্তিত্ব সংকটে। নাব্য হারিয়ে মৃতপ্রায় এসব নদী শুধু পরিবেশ নয়, হুমকির মুখে ফেলছে নৌ-পরিবহন ও নদীনির্ভর অর্থনীতিকে। গত এক দশকে এই অঞ্চলে ১৫টিরও বেশি নৌ-রুট বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে কমেছে জাহাজে পণ্য পরিবহন; বেড়েছে খরচ, সংকটে পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিকল্পিত পদক্ষেপ না নিলে নদী হারানোর সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতি পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়বে।

 

নদী সংকটের চিত্র

 

বটিয়াঘাটার শোলমারি নদীর চিত্র যেন গোটা দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিচ্ছবি। মাত্র দশ বছর আগেও এ নদী দিয়ে চলাচল করত বড় নৌযান, পাট, সার, সবজি পৌঁছে যেত দেশের নানা প্রান্তে। স্থানীয়রা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন নদীজুড়ে চর। কোথাও কোথাও হাঁটু সমান পানিও নেই। এই দৃশ্য আজ খুলনা অঞ্চলের অধিকাংশ নদীর বাস্তবতা।

 

একই রকম অবস্থা বটিয়াঘাটার গাওঘরা এলাকায় ভদ্রা নদী। এখানে বর্ষা মৌসুমে পানি থাকলেও শুকনো মৌসুমে নদীতে চর পড়ে থাকে। স্থানীয়রা নদী পারাপারের জন্য বাশ দিয়ে সাকোও তৈরী করেছেন। শুধু এই দুই স্থানে নয়, জেলার পাইকগাছা, দাকোপ উপজেলায় একাধিক নদীর অবস্থা একই রকম।

 

খুলনা অঞ্চলের অন্তত ৩৭টি নদী নাব্য হারিয়ে মৃতপ্রায় হয়ে হুমকির মুখে ফেলছে নৌ-পরিবহন ও নদী নির্ভর অর্থনীতিকে। ছবি: সময় সংবাদ

 

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) জানাচ্ছে, খুলনা বিভাগের অন্তত ৩৭টি নদী সংকটাপন্ন। এর মধ্যে খুলনার ময়ূর, ভৈরব, হামকুড়া, পশুর, মুক্তেশ্বরী, কাজীবাছা, যশোরের কুমার, হরিহর, সাতক্ষীরার ইছামতী, কুষ্টিয়ার কালিগঙ্গা ও ঝিনাইদহের বেতনাসহ বহু নদীর নৌচলাচল কার্যত বন্ধ। নওয়াপাড়া ও খুলনা নদী বন্দরে পণ্য পরিবহণও গত এক দশকে অর্ধেকে নেমে এসেছে।

 

শোলমারি নদীর তীরে বসে থাকা জেলে মফিজুল গাজী আক্ষেপ করে বলেন, ‘আগে এই নদী থেকে মাছ ধরে সংসার চলতো। এখন নদীতে মাছ নেই, পানি নেই। আমাদের পেশা শেষ হয়ে যাচ্ছে।’ একই এলাকার ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আগে পণ্য সহজে নদীপথে আনতে পারতাম। এখন নৌ-রুট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ট্রাকে আনতে হয়, খরচ তিনগুণ বেড়ে গেছে। বাজারে এর প্রভাব সরাসরি পড়ছে।’

 

আরও পড়ুন: পর্যটন খাতে এত কিছু থেকেও কেন পিছিয়ে বাংলাদেশ?

 

সংকটের কারণ

 

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবীদ সমিতি বেলার খুলনা বিভাগীয় প্রধান সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, ‘নদী সংকটের মূল কারণ হিসেবে উঠে আসছে উজান থেকে পানির প্রবাহ কমে আসা, নদী ও খাল ভরাট ও অবৈধ দখল, শহরের ড্রেনেজ ও শিল্প বর্জ্য নদীতে ফেলা, নদীর তীরে গড়ে ওঠা শত শত ইটভাটা, অনিয়ন্ত্রিত চর দখল ও বাঁধ নির্মাণ।’

 

তিনি বলেন, ‘নদী রক্ষায় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতর বছরের পর বছর অবহেলা করে গিয়েছে। আমরা বছরের পর বছর পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসক, নদী রক্ষা কমিশনসহ বিভিন্ন দপ্তরে নদী রক্ষায় বিভিন্ন সুপারিশ করে এসেছি। তবে দপ্তরগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। নদী বাঁচাতে উজানের পানির ঢলের প্রয়োজন, এজন্য রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। বিভিন্ন দপ্তর ড্রেজিংসহ অন্যান্য যেসব প্রকল্প নেই সেগুলো স্বচ্ছতার সাথে বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব করে যদি নদীগুলো রক্ষা করা না যায়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে এ অঞ্চল আরও বড় সংকটে পড়তে যাচ্ছে। পরিবেশের ক্ষতিকর প্রভাব বাড়তেই থাকবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে।’

 

খুলনা অঞ্চলের অন্তত ৩৭টি নদী নাব্য হারিয়ে মৃতপ্রায় হয়ে হুমকির মুখে ফেলছে নৌ-পরিবহন ও নদী নির্ভর অর্থনীতিকে। ছবি: সময় সংবাদ

 

কর্তৃপক্ষের অবস্থান

 

খুলনা অঞ্চলের নদীগুলো রক্ষায় একাধিক প্রকল্প গ্রহণের কথা বলছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সেসব প্রকল্প এখনও প্রাথমিক স্তরেই রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার নিরবাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, ‘শোলমারি ও শালতা নদী খননের জন্য প্রকল্প প্ল্যানিং কমিশনে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পে ড্রেজিং ও খাল খনন করা হবে। এর মধ্যে শোলমারি নদী খননে ৫০ কোটি টাকা ও শালতা নদী খননে ৩০ কোটি টাকা ব্যায় ধরা হয়েছে। এছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের সবগুলো নদী রক্ষায় করনীয় ঠিক করতে একটি স্ট্যাডি চলমান আছে। স্ট্যাডি শেষে নতুন প্রকল্পের প্রস্তাবনা করা হবে।’

 

একই রকমভাবে পরিকল্পনায় সীমাবদ্ধ বাংলাদেশ নদী বন্দর কৃতপক্ষের প্রকল্প। আইডব্লিউটিএ’র খুলনা অঞ্চলের উপ-পরিচালক মো. মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘মৃতপ্রায় নদী খনন, নদী বন্দর উন্নয়ন ও দখল উচ্ছেদে বড় প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। শিগগিরই এর কাজ শুরু হবে।’

 

আরও পড়ুন: মহানন্দা নদীর ভাঙনরোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি বাসিন্দাদের

 

নদী বাঁচানোর সুপারিশ

 

সম্প্রতি বেলা’র আয়োজিত আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা নদী রক্ষায় কিছু সুপারিশ দিয়েছেন। সুপারিশগুলো হলো: বর্ষায় বিস্তীর্ণ সমতল ভূমিতে বন্যার পানি প্রবেশের সুযোগ তৈরি করা, অপ্রয়োজনীয় স্লুইসগেট ও বাঁধ অপসারণ, সব চর দখলমুক্ত করা, সংযোগ খালগুলো সচল রাখা, ছোট ও নিচু সেতু-কালভার্ট ভেঙে বড় ও উঁচু সেতু নির্মাণ, নদীর প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণে গবেষণা ও ডেটাবেজ তৈরি। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে সমন্বিতভাবে।

 

নদী রক্ষায় কমর্সূচি

 

এদিকে বিশ্ব নদী দিবস আজ। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার এ দিবস পালন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষ্যে খুলনা অঞ্চলের নদ নদী রক্ষায় বিকেল ৫টায় বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার উদ্যোগে ভৈরব নদীর তীরে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হবে।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন