অভূতপূর্ব ফলনে সাড়া ফেলেছে ফকিরহাটের টমেটো ভিলেজ

৪ দিন আগে
বাগেরহাট থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে ফকিরহাট উপজেলার প্রত্যন্ত এক গ্রাম দহরমৌভোগ। ভৌগোলিক কারণে বছরের বেশিরভাগ সময় বিশেষ করে বর্ষাকালে এ অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এবং দহরমৌভোগ অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকা হওয়ায়, জলাবদ্ধতা এই অঞ্চলের কৃষির জন্য ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। স্থানীয়দের বেশিরভাগেরই জীবিকা নির্ভর করতো ঘেরকেন্দ্রিক মৎস্য চাষের ওপর। চারদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু চিংড়ির ঘের এবং কেউ কেউ সমন্বিত মৎস্য চাষ করত। চাষযোগ্য বিস্তীর্ণ ফসলি জমি কৃষকদের কাছে ছিল স্বপ্নের মতো ব্যাপার।

দিন বদলের শুরুটা হয় ঘেরের আইলে মাটি তুলে আইলে সবজি চাষের মাধ্যমে। কয়েকজন কৃষক ২০১৬ সালের দিকে প্রথম এই ধান ব্যতীত অন্য ফসলের চাষ শুরু হয়। ফকিরহাট  উপজেলার ২৪ টি ব্লকের একটি ব্লক মৌভোগ। মৌভোগ ব্লকের এক গ্রাম এই দহরমৌভোগ।


২০২০ সালে স্মলহোল্ডার অ্যাগ্রিকালচার কম্পিটীঈটভনেস প্রজেক্টের মাধ্যমে উপজেলা কৃষি অফিস প্রথমে ৭৫ জন কৃষকদের নিয়ে ৩টি দল তৈরি করে। এরপর গ্রুপভিত্তিক নানা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে  উচ্চমূল্যের ফসল উৎপাদনের নানা পদ্ধতি সম্পর্কে জেনে গ্রামের কৃষকরা ঘেরের আইলে শসা, করলা, টমেটো, অফ সিজন তরমুজ সহ নানা জাতের ফসল উৎপাদন শুরু করে।


বিগত চার বছরে এমন ভিন্ন ধর্মী উচ্চমূল্যের ফসল চাষের মাধ্যমে ভাগ্য ফিরেছে এলাকার মানুষের। শীতের মৌসুম শুরু না হতেই গ্রামের প্রায় ৮০ শতাংশ ঘেরের আইলে টমেটো চাষ করেছে তারা। কৃষিকাজে উন্নত প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্তি বদলে দিয়েছে এই এলাকার মানুষের রোজকার দিনলিপি। এমন ভিন্ন ধারার চাষ পদ্ধতির সমন্বয়ের মাধ্যমে এলাকার মানুষের ব্যস্ততাও বেড়েছে বহুগুণ। পরিবারের নারী সদস্যরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশ নিচ্ছে কৃষিকাজে।


 

টমেটো ক্ষেতের পরিচর্যা করছেন নারীরা। ছবি: সময় সংবাদ


নিজের স্বল্প জম্বির সাথে বর্গা নিয়ে চাষ করেছেন আগাম শীতকালীন টমেটোর শিবানী তরফদার নামে এক নারী। তিনি বলেন, ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ জমিতে একাই কাজ করে আমি টমেটো চাষ করেছি। স্বামী এখন অন্য জায়গায় কাজ করে, ভোরবেলায় চলে যায়। ঘরদোর সামলে আমি সারাদিন এই টমেটো ক্ষেতেই থাকি। আমার তিন ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ সবকিছু এই টমেটোর ওপর দিয়ে চলছে।


শিবানী তরফদার ছাড়াও বিনা রায়, সাধনা রায়, সুভাষিণী দেবী সবার সাথেই দেখা হলো টমেটো ক্ষেতে। গাছে পানি দেয়া থেকে শুরু করে, কীটনাশক, ভিটামিন দেয়াসহ গাছের সব ধরনের পরিচর্যা করছেন নিজেরাই। তারা বলেন, আগাম এই টমেটো চাষ করে শুধু শীতকালীন মৌসুমেই তারা প্রায় দেড় থেকে দুই লক্ষ টাকা আয় করতে পারবেন । তাছাড়া একইসঙ্গে তাদের অন্যান্য ফসলি জমিতেও বাঁধাকপি, ফুলকপি, লাল শাক ছাড়া বিভিন্ন জাতের সবজি চাষ করছে।


আরও পড়ুন: তেলবীজ উৎপাদনে ঝুঁকছেন কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলের কৃষকরা


দহরমৌভোগ গ্রাম ঘুরে ঘুরে দেখা গেল এক টুকরো জমিও কেউ ফেলে রাখেনি। এ যেন এক টমেটোর স্বর্গ। এ নিয়ে গ্রামের আরেক সফল কৃষক সুনিত্য রায় বলেন, এবারের বন্যায় আমাদের অনেক টমেটোর ক্ষতি হয়েছে কিন্তু আমি সব মরা গাছের গোড়ায় নতুন চারা দিয়েছি। তবে আমাদের ফলন যা হয়েছে তাতে ক্ষতি পুষিয়ে যাবে।


 

পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে টমেটো ক্ষেতে কীটনাশক ছিটানো হচ্ছে। ছবি: সময় সংবাদ


গ্রামের কোল ঘেঁষে এঁকেবেঁকে চলে গেছে রূপসার শাখানদী। ঘেরের আইল থেকে সরাসরি নৌকায় কখনো ভ্যানে করে চলে যায় স্থানীয় পাইকারি বাজারে। সেখান থেকে এই টমেটোর চালান চলে যায় ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। দহরমৌভোগের এমন টমেটো উৎপাদনের কারণে গ্রামেই গড়ে উঠছে ছোট ছোট আড়ত ।


এমনই একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সংগ্রাম তরফদার জানান, গ্রামে অনেকেই যাতায়াতের ঝামেলা এড়াতে জমি থেকে সরাসরি টমেটো বিক্রি করতে আগ্রহী। আমি ভ্যানে করে জমি থেকে টমেটো সংগ্রহ করি এবং আড়তে জমা করি। পরে ট্রাক বা পিকআপে করে ঢাকার ব্যবসায়ীরা আমার কাছ থেকে কিনে নিয়ে যায়।


 

দহরমৌভোগ গ্রামের এক কৃষকের ক্ষেত থেকে সংগ্রহ করা টমেটো। ছবি: সময় সংবাদ


লবণাক্ত মাটিতে উচ্চমূল্য ফসলের এমন ব্যাপক ব্যাপক সফলতা নিয়ে ফকিরহাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জনাব সাখাওয়াত হোসেন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় কৃষি বিভাগ দৃঢ়তার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। সে লক্ষ্যে উন্নত প্রযুক্তির সন্নিবেশ এবং প্রান্তিক কৃষকদের স্বনির্ভর ও স্বাবলম্বী করতে এসএসিপি-রেইন্স প্রকল্পের আওতায় আমরা কৃষকদের নানাভাবে সহযোগিতা করছি। সার বীজ এবং চাষাবাদে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিসহ সঠিক সময়ে সঠিক পদদক্ষেপ নিতে তাদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। আমাদের আপ্রাণ চেষ্টার ফসল এই দহরমৌভোগ গ্রাম। মৌসুমের বাইরে উচ্চমূল্য ফসল আবাদের ক্ষেত্রেও তারা অভূতপূর্ব সাফল্য পাচ্ছে। বিশেষ করে নারীরা এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। মোটাদাগে বলা যায় এই অঞ্চলের কৃষির এক হাব হয়ে উঠেছে এই গ্রাম।  


আরও পড়ুন: কলা বেচাকেনায় জমজমাট কুষ্টিয়ার মধুপুর হাট


উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সরকার এবং আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (IFAD) এর অর্থায়নে এবং ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন(FAO)-এর কারিগরি সহায়তায় পরিচালিত প্রকল্প, স্মল হোল্ডার অ্যাগ্রিকালচার কম্পিটিটিভনেস প্রজেক্ট দেশের জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলসহ ২০টি জেলায় কৃষকদের উন্নয়নে কাজ করছে।


উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গে কৃষকদের পরিচিতির ফলশ্রুতিতে স্বনির্ভর যুগোপযোগী কৃষি ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ এবং এভাবেই আর্থ সামাজিক উন্নয়নে কৃষকদের জীবনধারার পরিবর্তনের এক নতুন সূর্যোদয় উদিত হবে বিশ্বাস সংশ্লিষ্টদের ।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন