সূত্র জানিয়েছে, এ কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছে মাছ ও কাকড়া আহরণের জেলেরা। অনেক সময় কাকড়া ও বড় বড় মাছ শিকার করতে টোপ বানাতেও এক শ্রেণীর জেলে ব্যবহার করছে হরিণের মাংস। সুন্দরবন সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ ও কোস্টগার্ডের অভিযান অব্যাহত থাকলেও বনবিভাগ নিস্ক্রিয় বলে জানা গেছে।
মোংলার কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন সূত্র জানায়, গত এক মাসে হরিণ শিকারি চক্রের কাছ থেকে ৪২৩ কেজি হরিণের মাংস, ৮০টি হরিণ ধরা ফাঁদ এবং ৭ জন হরিণ শিকারীকে আটক করা হয়েছে। এছাড়া গত ৬ মাসে ৬শ’ কেজি মাংস, ৮টি চামড়া ও ২০ শিকারীকে আটক করা হয়েছে। সম্প্রতি গত ১২ মার্চ সুন্দরবনের মরালক্ষী খাল সংলগ্ন এলাকায় একটি বিশেষ অভিযান চালিয়ে কাঠের বোট তল্লাশি করে ২৫ কেজি হরিণের মাংস এবং হরিণ শিকারের ৮০ টি ফাঁদসহ ৫ শিকারীকে আটক করা হয়। আটক হরিণ শিকারীরা হলেন, মো. ইমরান গাজী (২৪), আবদুর রহিম (৪৩), রোকন উজজামান (৩৫), আবু মুসা (৩৬) এবং মো. মামুন (৩৫) । এরা সবাই খুলনা জেলার কয়রা থানার বাসিন্দা।
এর পরদিন ১৩ মার্চ রাতে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন সুন্দরবন সংলগ্ন নলিয়ানের বালুর মাঠ এলাকায় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে। এসময় ইয়াসিন গাজী নামে এক ব্যক্তিকে ২৮ কেজি হরিণের মাংসসহ আটক করা হয়।
আরও পড়ুন: ৯০ কেজি হরিণের মাংসসহ বোট জব্দ করল কোস্টগার্ড
গত ১৬ মার্চ রাতভর কোস্টগার্ড কৈখালী, হাড়বাড়িয়া ও মোংলার জয়মনিরঘোল এলাকায় পৃথক তিনটি অভিযান চালিয়ে ২০৫ কেজি হরিণের মাংস, ২টি হরিণের মাথা, ২টি হরিণের চামড়া ও ৮টি হরিণের পা’সহ ১ শিকারীকে আটক করে। আটক হরিণ শিকারী মো. বাবু আলম (২৭) সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর থানার বাসিন্দা। এরপর চলতি মাসের ৮ এপ্রিল সুন্দরবনসংলগ্ন ঠাকুরবাড়ী এলাকা থেকে ১১০ কেজি হরিণের মাংসসহ এক যুবককে আটক করে কোস্টগার্ড। আটক যুবকের নাম আরিফুল শেখ। তিনি দাকোপ উপজেলার বাসিন্দা।
এরপর ১১ এপ্রিল মোংলার জয়মিনর ঘোল এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি হরিণের চামড়াসহ ২৪ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। তবে এ সময় কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। সবশেষ গত ১৭ এপ্রিল মোংলার জয়মনির ঘোল এলাকায় একটি পরিত্যক্ত দোকানের সামনে থেকে ৩১ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করে কোস্টগার্ড। তবে এ সময় কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এবং বনবিভাগের কিছু অসৎ কর্মচারীর সহায়তায় শিকারীরা নিয়মিত হরিণ শিকার করছে। কোস্টগার্ড এবং বনরক্ষীদের হাতে দু/চারটি হরিণ পাচারের ঘটনা ধরা পড়লেও শিকারীরা আইনের ফাঁকফোঁকর দিয়ে খুব সহজেই বেরিয়ে আসছে বলে জানা গেছে।
আরও পড়ুন: মোংলায় ৩১ কেজি হরিণের মাংস জব্দ
জেলেরা জানান, হরিণ শিকার আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। গহীর বনে ফাঁদ পেতে হরিন মেরে মাংস বিক্রি করছে শিকারীরা। যারাই এ হরিণ শিকারের সঙ্গে জড়িত তারা সকলেই স্থানীয় প্রভাবশালীদের সাথে যোগাযোগ রেখেই এ অবৈধ কাজে নেমেছে। শিকারীদের বিরুদ্ধে কথা বললে হিামলা-মামলার হুমকি দেওয়া হয় তাদের। খোদ বনের মধ্যেই কাঁকড়া ও বড় মাছ শিকারীরাও ব্যাপকভাবে হরিণ মেরে কাকড়ার খাবার তৈরি করে থাকে বলে জানান তারা।
পূর্ব সুন্দরবনের জয়মনির ঘোল, বৈদ্যমারী, জিউধারা, নন্দবালা, দাকোপের রেখোমারী, সুন্দরবন ইউনিয়ন সংলগ্ন এলাকা। এছাড়া শরণখোলার সোনাতলা, পানিরঘাট, রাজাপুর, রসুলপুর, মোড়েলগঞ্জের জিউধরা,পাথরঘাটর চরদুয়ানী, জ্ঞানপাড়া এলাকার শিকারীরা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে জেলেবেশে সুন্দরবনে ঢুকে হরিণ শিকার করে লোকালয়ে নিয়ে আসে। অনেক চোরা শিকারী আবার গোপনে সুন্দরবনে ঢুকে হরিণ মেরে থাকে। রামপাল ও সাতক্ষীরা এলাকার কাকড়া জেলেরা কাঁকড়ার টোপ বানাতে নিয়মিত হরিণ শিকার করছে বলে জানা গেছে।
এছাড়া হরিণ বেশি শিকার হয় সুন্দরবনের সুপতি, দুবলা, কটকা, কচিখালী,বাদামতলা, চান্দেশ্বর, টিয়ারচর, কোকিলমুনি, আন্ধারমানিকসহ গভীর বনের সুবিধাজনক স্থানে নাইলনের ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে থাকে। শিকারীরা মাছের পেটিতে বরফ দিয়ে সুবিধাজনক সময় লোকালয়ে পাচার করে থাকে। আর পাইকারি দরে প্রতি কেজি হরিণের মাংস বিক্রি করছে ৭শ’ টাকা। সেগুলো গ্রাম বা শহরের বিক্রি হচ্ছে ৮শ’ থেকে এক হাজার টাকা।
আরও পড়ুন: বরগুনায় ৩৫ কেজি হরিণের মাংসসহ শিকারি গ্রেফতার
হরিণ শিকার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফাঁদ, বিষটোপ এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে হরিণ শিকার করা হয়। কোনো কোনো সময় শিকারী চক্র মাছ ধরার জেলেদের ছদ্মবেশে বনের গহিণে গিয়ে হরিণ শিকার করে তা গোপনে লোকালয়ে আনছে। পরে শিকার করা হরিণ কৌশলে লোকালয় থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করা হয়। এ জন্য সংঘবদ্ধ শিকারী চক্রের লোকালয়ে নির্দিষ্ট এজেন্ট নিয়োজিত রয়েছে। এসব এজেন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন হাত বদল হয়ে পৌয়ে যায় তাদের নিজেস্ব গন্তব্যে।
এ ব্যাপারে সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘হরিণ শিকার বন্ধে কোস্টগার্ডের কিছু অভিযান দৃশ্যমান হলেও বনবিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাজসে আর দায়িত্বে অবহেলার কারণে সুন্দরবনে এই অপতৎপরতা বেড়েই চলেছে। বনবিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি ধরা পড়া হরিণ শিকারীদের জন্য কঠোর আইনও করা জরুরি।
পূর্ব সুন্দরবনের চাদঁপাই রেঞ্জ কর্মকর্তা রানা দেব বলেন, ‘হরিণ শিকারীদের ধরতে বনবিভাগের নিয়মিত টহল অব্যাহত আছে। বন বিভাগের কেউ জড়িত থাকলে প্রমাণ পেলে কঠোর ব্যাবস্থা নেয়া হবে। আর শিকারীদের অপতৎপরতা ঠেকাতে যে আইন আছে, সেই আইন আরও কঠোর করতে সংস্কারের প্রক্রিয়া চলছে।
কোস্টগার্ডের মিডিয়া কর্মকর্তা লে. কমান্ডার সিয়াম উল হক বলেন, ‘সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং বণ্যপ্রাণী শিকার ও পাচার রোধে আমাদের নিয়মিত অভিযান চলমান রয়েছে। এছাড়া সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় আমাদের গোয়েন্দা তৎপরতাও বৃদ্ধি করা হয়েছে।’