জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের উদ্যোগে স্টেডিয়ামের ভেতরে আয়োজন করা হয়েছিল শিল্প ও বাণিজ্য মেলা। তবে মেলা শেষ হওয়ার এক মাস এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও মাঠে নেয়া হয়নি কোনো সংস্কার কার্যক্রম। ফলে এখনও স্টেডিয়ামের ভেতর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইট, বাঁশ, কাঠ আর পাথরের স্তূপ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন মেলা চলার পর পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকায় মাঠজুড়ে জন্মেছে আগাছা ও ঝোপঝাড়। স্টেডিয়ামের ঘাসে তৈরি হয়েছে জঙ্গল। ক্রিকেটের পিচে জন্ম নিয়েছে ছোট গাছ, ফুটবল মাঠের মাঝখানে জমে রয়েছে পানি। এমন অবস্থায় গত তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে বিভিন্ন বয়সের খেলোয়াড়দের নিয়মিত অনুশীলন ও খেলা। মাঠজুড়ে ছড়িয়ে আছে ইটের টুকরো আর পাথর, আর জায়গায় জায়গায় তৈরি হয়েছে গর্ত ও খানাখন্দ।
আরও পড়ুন: খেলার মাঠ খুঁড়ে মেলা!
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার হরিপুর এলাকার তরুণ খেলোয়াড় তারেক রহমান প্রায় এক বছর ধরে নিয়মিত অনুশীলন করে আসছিলেন জেলা স্টেডিয়ামে। তিনি বলেন, ‘আমরা নিজেরাই মাঠের পরিচর্যা করতাম। কোচদের সঙ্গে মিলে নিয়মিত পানি দিতাম, ঘাস কাটতাম। কিন্তু হঠাৎ তিন মাস আগে স্টেডিয়ামে মেলা বসানোর পর সব বন্ধ হয়ে যায়। এখন আর সেখানে যেতে পারি না। অনেক কষ্ট করে শহরের বাইরের একটি মাঠে প্র্যাকটিস করছি, যেটা অনেক দূরে।’
একই অভিজ্ঞতা ফুটবলার সোহানেরও। তিনি বলেন, ‘জেলা স্টেডিয়ামে যাওয়ার মতো অবস্থা নেই। মাঠটা দেখে কষ্ট লাগে। মাঠ খুঁড়ে বাঁশ পুঁতে রাখা হয়েছে এখনো। পানিতে ভরা কাদা আর ইট-পাথরের টুকরো পড়ে আছে চারদিকে। অথচ আমাদের বলা হয়েছিল মেলা শেষ হলেই মাঠ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু এখন ৫ সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও সংস্কারের কোনো কাজই শুরু হয়নি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কোচ সময় সংবাদকে বলেন, ‘এসব নিয়ে আসলে বলার ভাষা খুঁজে পাই না। মাঠের ভেতরে যেভাবে ইট-পাথর ও বাঁশ পুঁতে রাখা হয়েছে, মনে হয় যেন সেটা আমাদের বুকের ওপরই গেঁথে বসানো হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন একবার অনুমতি দিলে আর কিছু করার থাকে না। এখন এই মাঠে যদি প্র্যাকটিস করেও, ছেলেদের ইনজুরির ঝুঁকি থেকে যায়।’

পঞ্চাশোর্ধ্ব কলেজ শিক্ষক হাসান আলী বলেন, ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ার মঞ্চটাকেই যেভাবে মেলার মাঠ বানানো হয়েছে, তাতে জেলার মানুষ বিস্মিত। শুনছি, জেলা প্রশাসক নাকি ১৬ লাখ টাকার বিনিময়ে মেলার আয়োজন করতে দিয়েছেন। প্রশাসন ও ক্রীড়া সংস্থা মিলে অর্থ নিলেও, এর বিনিময়ে ঠেলে দিয়েছে জেলার প্রতিভাবান তরুণদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। আমরা চাই, বিষয়টি ক্রীড়া মন্ত্রণালয় গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করুক এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।’
জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব মনিরুজ্জামান মনির বলেন, ‘মেলার শুরুর আগে চেম্বার অব কমার্স ও মেলা আয়োজক কমিটি জানিয়েছিল মেলা শেষ হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে মাঠ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু এখন এক মাস এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও সংস্কারের কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক ও হতাশাজনক।’
স্থানীয় উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত ও ঐতিহ্যবাহী পণ্যকে তুলে ধরার কথা বলে অনুমতি নেয়া হলেও বাস্তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ স্টেডিয়ামে আয়োজিত তথাকথিত শিল্প ও বাণিজ্য মেলায় ছিল নিম্নমানের ও বিদেশি পণ্যের ছড়াছড়ি। জেলা ক্রীড়া সংস্থার এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে সময় সংবাদকে জানান, মেলার শুরুতে স্থানীয় পণ্যের প্রচারের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও মাঠে দেখা যায় ঠিক উল্টো চিত্র। প্রায় দেড় শতাধিক স্টলের মধ্যে মাত্র একটি স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল স্থানীয় একজনের নামে, সেটিও ছিলেন মহিলা লীগের এক নেত্রী। জেলার শত শত উদ্যোক্তা স্টলের আশায় থাকলেও বরাদ্দ দেয়া হয় শুধু জেলা মহিলা লীগের কোশাধ্যক্ষ রাজিয়া সুলতানা সম্পাকে-যিনি আবার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি আব্দুল ওদুদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
তিনি আরও বলেন, এমনকি মেলার এক পর্যায়ে স্টলের ভেতর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে কেক কাটার মতো রাজনৈতিক কর্মসূচিও পালিত হয়। এই ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়, যার প্রেক্ষিতে পুলিশ ২৪ জুন রাতে ওই নারী নেত্রীকে আটক করে। পুরো মেলাটিই ছিল বিতর্কে ভরা। জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে এ নিয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
আরও পড়ুন: অনুমতি ছাড়া বাণিজ্য মেলা, বন্ধ করল উপজেলা প্রশাসন
এ নিয়ে বারবার চেষ্টা করেও জেলা প্রশাসক ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার আহ্বায়ক মো. আব্দুস সামাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। এমনকি হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠালেও সাড়া দেননি।
তবে ক্যামেরার সামনে না এলেও মেলার আয়োজক কমিটি ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, খুব শিগগিরই স্টেডিয়াম সংস্কার করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে। মেলা কমিটির আহ্বায়ক ও চেম্বার অব কমার্সের সহ-সভাপতি খাইরুল ইসলাম মুঠোফোনে সময় সংবাদকে বলেন, ‘আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় সংস্কারকাজে বিলম্ব হচ্ছে। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই মাঠ পুনরায় খেলার উপযোগী করে তোলা হবে।’
প্রসঙ্গত, প্রায় দেড় মাসব্যাপী এই তথাকথিত শিল্প ও বাণিজ্য মেলায় দেড় শতাধিক স্টল বসানো হয়। অথচ ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ঐতিহ্যবাহী চাঁপাইনবাবগঞ্জ স্টেডিয়ামে প্রতিদিন নিয়মিত অনুশীলন করে শতাধিক বয়সভিত্তিক ক্রিকেট ও ফুটবল খেলোয়াড়।
]]>