সাদা পাথরখেকোদের দখলে পর্যটন করপোরেশনের ৫০ একর জমি, ট্যুরিজম বোর্ডের প্রাচীর গায়েব

৪ সপ্তাহ আগে
সিলেটে পর্যটন স্পটের পাথর লুটপাটের তুলকালামকাণ্ডের পর প্রশাসনের টনক নড়লেও আড়ালে রয়ে গেছে প্রভাবশালী চক্রটির আরেক অপকর্ম— সাদা পাথর নিকটবর্তী সরকারি জমি দখলের ঘটনা। যেখানে দিনে দুপুরে পর্যটন করপোরেশনের সীমানা প্রাচীর ভেঙে জমি দখলের পর লুটের পাথর স্তূপ করে রাখার জায়গা করেছিল চক্রটি, বসানো হয়েছিলো পাথর ভাঙার কল।

অভিযোগ আছে, এখান থেকে দিনরাত চলে লুট হওয়া পাথর ভেঙে ঢাকায় পাঠানোর কর্মযজ্ঞ, রাজনৈতিক নেতাসহ কয়েকটি গ্রুপ একযোগে এই জমি থেকে চাঁদা বাবদ বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও রয়েছে। যদিও অজানা ভয়ে কেউই এখন মুখ খুলতে চাচ্ছেন না। পাথর উদ্ধার অভিযান চললেও এখনো বেদখল হওয়া সরকারি জমি উদ্ধার করতে পারেনি স্থানীয় প্রশাসন, মেলেনি প্রশাসনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্যও। তবে ট্যুরিজম বোর্ড বলছে, নতুন সীমানা প্রাচীর নির্মাণে নেয়া হচ্ছে ব্যবস্থা।


গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সিলেটের ভোলাগঞ্জে একটি প্রভাবশালী চক্র পর্যটন করপোরেশনের ৫০ একর সরকারি জমি জোরপূর্বক দখলে নেয়। বুল্ডুজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হয় ২০২৩ সালে দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের নির্মাণ করা সীমানা প্রাচীর। কোনো কোনো স্থানে উপড়ে ফেলা হয় প্রাচীরের ভিত্তি পর্যন্ত। এই তাণ্ডব চালানোর মধ্যদিয়েই সাদা পাথর ও রেলওয়ে বাংকার এলাকায় ব্যাপক পাথর লুট শুরু হয় বলে অভিযোগ বিস্তর, এই জমি দখলে চক্রটির পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতাদের যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে।


আরও পড়ুন: পাথর লুট: সিলেটের কোম্পানিগঞ্জ থানার ওসিকে বদলি


নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কোম্পানীগঞ্জের কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা সময় সংবাদকে বলেন, লুটপাটের ক্ষেত্রে কোনো দল বা আদর্শ বিচার করে কেউ লুট করেনি, সব দলমতের মানুষ একত্রে মিলেমিশে পাথর খেয়েছে। স্থানীয় বিএনপির একটি প্রভাবশালী বলয় সরকারি জমি দখল করেছে, ওই জমিতে পাথর রাখতে ও পাথরভাঙা কল বসানোর বিনিময়ে ভাড়া আদায় করেছে, প্রশাসনের নাকের ডগায় এই অপকর্ম দিনের পর দিন চলেছে, মূলত সরকারি জমির দেয়াল বুল্ডুজার দিয়ে ভেঙে দখল নেয়ার মধ্য দিয়েই এই তাণ্ডব শুরু হয়।

 

যেভাবে সরকারি জমি ব্যবহার

 

ভোলাগঞ্জ সাদা-পাথর পর্যটন স্পটের লাগোয়া রেলওয়ে বাঙ্কার থেকে প্রথমে দিনে-রাতে বিপুল পরিমাণ পাথর লুট করা হয়। সে সময়ে ২০২৪ সালের ১৩ অক্টোবর পাথর লুটের রাতের চিত্র তুলে ধরে বিশেষ প্রতিবেদন প্রচার করে সময় সংবাদ। প্রতিবেদনটির পর দায়সারা একটি অভিযানও চালায় প্রশাসন। এরপরও চলতে থাকে লুটপাট, নজর পড়ে বাঙ্কার নিকটবর্তী সাদা পাথর এলাকায়। সেখান থেকে পাথর লুট করে আমদানি করা পাথরের সঙ্গে রাখা হতো এই সমতল জমিতে, এখানেই বসানো হয়েছে অসংখ্য পাথরভাঙা কল; যা এখনো প্রকাশ্যেই দিন-রাত চলছে। তবে অভিযানের কারণে সরিয়ে ফেলা হয়েছে সাদা পাথর।

 

সরকারি জমি দখল করে চলছে পাথর ভাঙার কাজ। ছবি: সময় সংবাদ


সরকারি এই বেদখল হওয়া জমিতে এখনও আমদানি করা পাথর স্তূপ করে রেখে দিয়েছেন পাথর ব্যবসায়ীরা।


জনমনে নানা প্রশ্ন

 

সড়কের পাশেই সরকারি জমির কোটি টাকার দেয়াল ভেঙে দখল করে ভাড়া ও চাঁদা বাবদ লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ থাকলেও থানা পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের নীরব ভূমিকা জনমনে জন্ম দেয় নানা প্রশ্নের। সাদা পাথরকাণ্ডে অভিযান চলমান থাকলেও পর্যটন করপোরেশনের দখল হওয়া এই জমি এখনো কেনো উদ্ধার করা গেলো না? বা কারা এখনও প্রভাব খাটিয়ে এসব চালাচ্ছে তা জানতে চেষ্টা করে সময় সংবাদও। তবে চক্রের সদস্যদের নাম মুখে আনতেও যেনো ভয় সবার!


ভোলাগঞ্জ কাস্টমস অফিস নিকটবর্তী এলাকায় কয়েকজন ব্যক্তি নিজেদের পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, সরকারি দেয়াল অনেক মজবুতভাবে বড় অঙ্কের টাকা খরচ করে নির্মাণ করা হয়েছিল। দেয়ালের উপরের অংশে ছিল গ্রিল ডিজাইন, ৫ তারিখের পর পে লোডার (বুল্ডুজার) দিয়ে এই দেয়াল ভাঙা হয়, চুরি করে নেয়া হয় সব গ্রিল। এমনকি রড পর্যন্ত কেটে নেয় একটি গ্রুপ। তারপর আগে যেমন দখলে ছিল তেমনি যে যার মতো দখল করে পাথর ভাঙার মেশিন বসাতে থাকে।

 

জমিতে যাদের মেশিন চলছে তাদের বক্তব্য

দখল হওয়া ৫০ একর জমিতে যায় সময় সংবাদ, কথা বলার চেষ্টা করে এখানে যাদের পাথরভাঙা মেশিন চলছে এবং যারা পাথর রেখেছেন তাদের সঙ্গে। তবে কেউই তাদের নাম পরিচয় জানাতে আগ্রহী নন।


তারা বলছেন, আমরা কাউকে ভাড়া দিই না। যে যার মতো জমিটি ব্যবহার করছি, সরকারের জমি সরকার যখন বলবে ছেড়ে দেবো। কে বা কারা দেয়াল ভেঙেছে তারা দেখেননি।


আরও পড়ুন: ভোলাগঞ্জ থেকে লুট হওয়া ৫০ হাজার ঘনফুট পাথর জব্দ


অনেকে আবার বলছেন, ৫ তারিখের পর ছাত্ররা দেয়াল ভেঙেছে, শ্রমিক-জনতা একসঙ্গে দখল করেছে। এমন বক্তব্যের বিপরীতে ছাত্ররা কেনো দেয়াল ভেঙে জমি দখল করতে যাবে? প্রশ্নের জবাবে কোনো সদুত্তর মিলেনি।


ছাত্র প্রতিনিধির বক্তব্য

 

দেয়াল ভেঙে পর্যটন করপোরেশনের সরকারি জমি দখলে ছাত্রদের নাম জড়িয়ে দেয়ার চেষ্টার ব্যাপারে কোম্পানীগঞ্জের বাসিন্দা ও এনসিপির সিলেট জেলা আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আব্দুল ওয়াদুদ শিপনের বক্তব্য জানতে চায় সময় সংবাদ।


তিনি বলেন, ‘ছাত্ররা কোনোভাবেই কোনো সরকারি জমি দখল করে ওই জমির দেয়াল ভাঙতে যায়নি বা কখনো এমন কাজ করতে যাবে না। এই কাজ করেছে তারাই যারা আগে এই জমি দখল করে রেখেছিল। তারা সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের ফায়দা হাসিল করতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। ছাত্রদের নাম এখানে যারা আনছেন তারা নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে এখন মরিয়া হয়ে উঠেছেন। আমরা চাই দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত হোক।’


এদিকে দখলের ব্যাপারে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির পদ স্থগিত হওয়া সভাপতি ও পলাতক বিএনপি নেতা সাহাবুদ্দিন আহমেদ।


তিনি বলেন, ‘আমরা বার বার প্রশাসনকে বলেছি লুটপাট ও এসব জবর দখল বন্ধ করতে। ইউএনও কল রিসিভ করেননি। আমাদের কথায় তারা কোনো কর্ণপাত করেননি। আমরা মানববন্ধন করেছি, বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছি। পুলিশ ও প্রশাসন চাইলেই সব লুটপাট-ভাঙচুর-দখল বন্ধ করতে পারতো, তখন তারা এসব করেননি, আর এখন আমার ওপর সব দায় চাপিয়ে সবাই বাঁচতে চায়। বিএনপি কোনোভাবেই এই জমি দখল বা লুটপাটে জড়িত নয়।’

 

দায়িত্বশীলদের বক্তব্য

 

নতুন সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করতে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের পরিচালক (বিপণন ও পরিকল্পনা) সালেহা বিনতে সিরাজ।


তিনি সময় সংবাদকে বলেন, ‘জায়গাটা পর্যটন করপোরেশনের। আমরা প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করে দিয়েছিলাম। যাতে এই পর্যটন স্পটের সম্পদ রক্ষিত থাকে। কিন্তু দেয়ালটি ভেঙে ফেলা হয়েছে জেনেছি। আমরা আবারও নতুন করে দেয়ালটি নির্মাণ করে দেবো। সে অনুযায়ী আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে।’


এদিকে, সম্প্রতি সাদাপাথর এলাকা পরিদর্শন শেষে কোম্পানীগঞ্জে ঘটে যাওয়া পাথরকাণ্ডসহ যাবতীয় সব অপরাধ কর্মকাণ্ডে দায়িত্ব অবহেলার প্রমাণ পেলে ওসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান।


আরও পড়ুন: সাদাপাথরে ১৫ লাখ ঘনফুট পাথর প্রতিস্থাপন, উদ্ধার প্রায় ২৮ লাখ ঘনফুট


সংবাদটি লেখা পর্যন্ত কোম্পানীগঞ্জ থানার অভিযুক্ত ওসি উজায়ের আলম আদনানকে বদলির আদেশ দেয়া হয়।


পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এই লুটপাট দখলসহ যতো অপরাধ হয়েছে সবকিছুর তদন্ত হচ্ছে। এই অপরাধের সঙ্গে আমাদের ডিপার্টমেন্টের যতো বড় কর্মকর্তাই জড়িত থাকবেন তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার পাশাপাশি বিভাগীয় মামলা করা হবে।’


অন্যদিকে, দখল হওয়া সরকারি জমি উদ্ধারের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দিতে চাননি নবাগত জেলা প্রশাসক সারোয়ার আলম।


তবে তিনি পর্যটন স্পটগুলোতে চুরি যাওয়া পাথর প্রতিস্থাপনের পর দখল হওয়া সরকারি এই জমি উদ্ধারে অভিযান শুরু করবেন বলে জানিয়েছেন।


ভোলাগঞ্জের সাদা পাথরকে কেন্দ্র করে পর্যটন বিকাশে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলো সরকার। জমি অধিগ্রহণ হলেও প্রভাবশালী চক্রটির দাপটে আটকে গেছে প্রকল্পের অগ্রগতি।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন