পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এই পুকুর ঘিরে ছড়িয়ে আছে নানা উপকথা, ধর্মীয় বিশ্বাস ও মুগ্ধতার গল্প। কথিত আছে, মানুষের তৃষ্ণা মেটাতে স্বয়ং দেবতারা এই পুকুর খনন করেছিলেন হাজার ফুট উচ্চতায়। স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বী ত্রিপুরা সম্প্রদায় বিশ্বাস করে, দেবতা নিজে খনন করেছেন এই জলাধার- যার পানি কখনো শুকায় না, এমনকি পরিষ্কার করতেও হয় না!
পুকুরটি খাগড়াছড়ি জেলা সদরের নুনছড়ি ত্রিপুরা পাড়ায়, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় এক হাজার ফুট উঁচুতে। জেলা সদর থেকে মাইচছড়ি হয়ে আরও চার কিলোমিটার পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ অতিক্রম করে পৌঁছাতে হয় ছবির মতো সুন্দর এক ত্রিপুরা পাড়ায়। সেখান থেকে হেঁটে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে হয়।
সিঁড়ির সংখ্যা ১ হাজার ৪৮১ ধাপ। দীর্ঘ এই যাত্রাপথে পায়ে চলার ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয় পাহাড়ি ঝরনার শব্দ, পাখির কিচিরমিচির আর ছায়াঘেরা গাছপালার দৃশ্য। পুকুরের পাশেই রয়েছে প্রাচীন বটগাছ এবং একটি শিবমন্দির, যেখানে পূজা দেন তীর্থযাত্রীরা।
ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের প্রবীণ গোলক কুমার (৮২) বলেন, তার দাদার মুখে তিনি শুনেছেন- পাহাড়ের চূড়ায় একসময় দুটি পাড়া ছিল। এক জুমচাষি বারবার স্বপ্নে নিষেধ সত্ত্বেও জুমচাষ অব্যাহত রাখেন। এক অমাবস্যার রাতে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর সেই স্থানে সৃষ্টি হয় একটি বিশাল পুকুর। সেই থেকেই পুকুরটি অলৌকিক বলে গণ্য হয়ে আসছে।
প্রতি বছর চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে এখানে বসে মেলা। তীর্থযাত্রীরা দেবতা পুকুরে গোসল করে পাশের শিবমন্দিরে পূজা দেন। তাদের বিশ্বাস, এই স্থানে পূজা দিলে পূর্ণ হয় সব মনোবাঞ্ছা।
আগে দেবতা পুকুরে পৌঁছাতে হতো দুর্গম পাহাড়ি কাঁচা পথে। বর্ষায় ছিল চরম ভোগান্তি। তবে ২০১৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড পর্যটকদের সুবিধার্থে নির্মাণ করে দেয় পাকা সিঁড়ি ও অবকাঠামো। পথে তৈরি হয়েছে একাধিক বিশ্রামাগার, ফলে বৃদ্ধরাও এখন সহজে পুকুরে পৌঁছাতে পারেন।
আরও পড়ুন: উত্তর জনপদে পর্যটনের সম্ভাবনা বিকশিত হচ্ছে না কেন?
পর্যটক অপু দত্ত ও সুমিতা ত্রিপুরা জানান, আগে যেতে সময় লাগতো প্রায় দুই ঘণ্টা। এখন মাত্র ৪৫ মিনিটে পৌঁছে যান।
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে চোখে পড়ে পাহাড়ি ঝরনা, সবুজ পাহাড়ের ভাঁজে ভেসে থাকা মেঘ, আর চারপাশে নিসর্গের মুগ্ধতা। ঢাকার পর্যটক পার্থ দেবনাথ ও কাকলী ভৌমিক বলেন, “পুরো যাত্রাপথটাই যেন এক স্বপ্ন। সবুজের রাজ্যে ঘেরা স্বচ্ছ পানির পুকুর- এমন দৃশ্য হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
অপর পর্যটক খায়রুজ্জামান বলেন, 'পাহাড়ি এলাকায় যেখানে পানির জন্য বাঁধ দিতে হয়, সেখানে এত ওপরে প্রাকৃতিকভাবে এমন একটি পুকুর থাকা সত্যিই অবিশ্বাস্য।'
বর্তমানে দেবতা পুকুর এবং মায়ুং কপাল সিঁড়ি বা হাতির মাথা সিঁড়ি খাগড়াছড়ির অন্যতম দু’টি পর্যটন কেন্দ্র। মায়ুং কপাল সিঁড়ির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩২০ ফুট এবং দেবতা পুকুরের সিঁড়ি প্রায় ২ হাজার ৫০০ ফুট দীর্ঘ বলে জানান স্থানীয়রা।