আজ সেই সন্দ্বীপের কথা বলব। বলব তার ইতিহাস, তার প্রকৃতি, তার মানুষ, তার কষ্ট, তার ভালোবাসা আর নিরবধি স্বপ্নের কথা।
জন্মভূমির টান: 'আমি সন্দ্বীপ্পা!'
'চলো যাই বঙ্গোপসাগরের তীরে সন্দ্বীপে' এই এক লাইনে আটকে আছে হাজারও মানুষের আত্মিক টান। আজও যখন বিদেশে থাকা সন্দ্বীপবাসী কেউ পরিচয় দেন, তারা বলেন, 'আমি সন্দ্বীপ্পা'। এ এক পরিচয়ের অহংকার, এক শিকড়ের ঘ্রাণ।
সন্দ্বীপ মানেই- জানের সন্দ্বীপ, প্রাণের সন্দ্বীপ, আমার সন্দ্বীপ, আমাদের সন্দ্বীপ, সোনালী সন্দ্বীপ, আলোয় ভাসা সন্দ্বীপ। চট্টগ্রাম শহরের পাশেই অবস্থিত এই দ্বীপটি যেন সভ্যতা থেকে কিছুটা দূরে থাকলেও হৃদয়ের গভীরে একদম কাছে। সন্দ্বীপ চ্যানেলের অপর প্রান্তে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও মীরসরাই, উত্তরে বামনী নদী, পশ্চিমে মেঘনা আর দক্ষিণে সাগরবেষ্টিত এই দ্বীপ একাই এক মহাকাব্য।
'আই সন্দ্বীপ্পা'- এই পরিচয় সন্দ্বীপবাসীর হৃদয়ের এক অটুট বাঁধন, এক গভীর ভালোবাসার প্রকাশ। সন্দ্বীপের মাটির সাথে তাদের সম্পর্ক কখনো ছিন্ন হয়নি, বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও মজবুত হয়েছে।
যেখানেই থাকুক, ঢাকায় হোক বা বিদেশের কোনো প্রান্তে, তারা গর্বের সঙ্গে উচ্চারণ করে 'আমি সন্দ্বীপ থেকে এসেছি'। শহরের ভিড়ে বা দূর বিদেশের ব্যস্ততায় এই টান কখনো ম্লান হয় না। সন্দ্বীপের মাটির গন্ধ, নদীর সুর, বাতাসের নোনা স্বাদ, শৈশবের স্মৃতি- এসব তাদের হৃদয়কে বারবার সেই ছোট্ট স্বপ্নীল দ্বীপের দিকে টানে।
বছরে একবার হলেও সন্দ্বীপে ফেরার আশায় তারা বুক বাঁধে। কারো কাছে হয়তো এটা শুধুই পুরোনো বাড়ি বা গ্রামের কথা, কিন্তু সন্দ্বীপবাসীর জন্য এটি তাদের অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে ফিরে এসে তারা শৈশবের স্মৃতির ঝুলি খুলে ফেলে নদীর পাড়ে, নারকেল গাছের ছায়ায়, মাঠের কাদামাটিতে।
প্রকৃতি: নীল, সবুজ আর সোনার এক মহামিলন
সন্দ্বীপের প্রকৃতি যেন কবিতার মতো। সোনালী বালির ওপর হেঁটে যেতে যেতে যেভাবে নুড়ি পায়ে বাজে, সমুদ্রের ঢেউ যেভাবে ছুঁয়ে যায়, বাতাসে নারকেল পাতার ঝিরঝির শব্দ যেভাবে বাজে- সব মিলিয়ে এক জীবন্ত প্রকৃতিচিত্র। দ্বীপের ভোর শুরু হয় পাখির কুজন আর শিশির ভেজা ঘাসে। নদীর ধারে ঝরে এক ঝলমলে রোদ, দুপুরে উর্বর মাটিতে কৃষকের কাজ, আর সন্ধ্যায় নদীর পাড়ে বসে সূর্যাস্তের দৃশ্য যেন এক শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবি।
প্রতিটি ভোরের কুয়াশায়, সন্ধ্যার সোনালী আলোয় সন্দ্বীপ যেন নতুন জীবনে সেজে ওঠে। তার মিষ্টি মিঠা বাতাস, নদীর ধারে ঘনসবুজ বন আর দূরে দূরে বিস্তৃত ধানক্ষেতের নীল-সবুজ ঢেউ যেন এক অপরূপ সংগীত সৃষ্টি করে। এখানকার প্রকৃতির সরলতা আর সৌন্দর্য সন্দ্বীপবাসীর জীবনকে যেমন শুদ্ধ করে, তেমনি তার হৃদয়ে এক অনন্য প্রশান্তি দিয়ে যায়।
সন্দ্বীপের প্রকৃতি শুধু চোখে ভালো লাগে না, মনের গভীরেও স্পর্শ করে। এটি তাদের জীবনের আত্মা, যেখানে তারা খুঁজে পায় শান্তি, স্বপ্ন আর পুনর্জন্মের বার্তা।
এখানে ফসল ফলে প্রকৃতির নিয়ম মেনে। শস্য ফলানো, মাছ ধরা, লবণ উৎপাদন এই দ্বীপের চিরায়ত পরিচয়। যান্ত্রিকতার বাইরে এই দ্বীপের মানুষ প্রকৃতির সাথে সহাবস্থানে গড়ে তুলেছে তাদের জীবন।
মানুষের জীবন ও সংগ্রাম
সন্দ্বীপের মানুষের জীবন একদিকে সুন্দর, অন্যদিকে কঠিন। এখানে প্রকৃতি যেমন দেয়, তেমনি আবার কেড়ে নেয়। নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা- এসব এই দ্বীপবাসীর নিত্যসঙ্গী। বহু মানুষ হারিয়েছেন বসতভিটা, শৈশবের স্কুলঘর, এমনকি পরিবারের সদস্যও। তারপরও তারা বেঁচে আছেন, যুদ্ধ করে যাচ্ছেন।
প্রকৃতির সঙ্গে, নদীর সঙ্গে, ঘূর্ণিঝড় আর ভাঙনের সঙ্গে প্রতিদিন যুদ্ধ করে টিকে থাকার নামই এখানে জীবন। মেঘনার ভাঙনে যাদের ভিটেমাটি বারবার সরে গেছে, তারা আজও নতুন করে গড়ার স্বপ্ন দেখে। তাদের হাতে গড়া কাঁচাঘর, বাঁশের বেড়া, কাদামাটির পথ- সবই টিকে থাকে সাহস আর শ্রমের জোরে।
দ্বীপবাসীর জীবনের বড় অংশই কৃষি ও মাছ ধরার সঙ্গে জড়িত। সূর্য ওঠার আগেই তারা নেমে পড়েন খেতে, নদীতে, সমুদ্রে। নারীরা পাশে থাকেন ঘরের কাজ, সন্তান পালন, এমনকি চাষাবাদের অংশ হিসেবেও।
দারিদ্র্য সত্ত্বেও তারা অতিথিপরায়ণ, গর্বিত আর মাটির মানুষ। একবেলা খেয়ে হলেও অতিথিকে খাওয়ানোর চেষ্টা এদের সহজাত।
শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থানে সীমাবদ্ধতা থাকলেও সন্দ্বীপবাসী হাল ছাড়েন না। অনেকেই সন্তানদের পড়াতে শহরে পাঠান, প্রবাসে পাঠান—ভবিষ্যৎ গড়ার আশায়।
এই সংগ্রাম কেবল জীবনধারণের জন্য নয়, এটি সম্মান, শিকড় আর ভবিষ্যতের জন্য একটি লড়াই।
এই দ্বীপের মানুষই সন্দ্বীপের আসল সৌন্দর্য। তারা ঘামের বিনিময়ে গড়ে তুলেছে এক টেকসই ভালোবাসার পৃথিবী—যার ভিত্তি ভেঙে ফেলা যায় না, আর যার গল্প শুনলে বুক গর্বে ভরে ওঠে।
আরও পড়ুন: উত্তাল সমুদ্রে ঝুঁকি নিয়েই যাতায়াত সন্দ্বীপের লাখো বাসিন্দার
সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও আবেগ
সন্দ্বীপ শুধু নদী-বেষ্টিত একটি দ্বীপ নয়, এটি একটি জীবন্ত সংস্কৃতি। এখানে প্রতিটি মৌসুম, প্রতিটি উৎসব, প্রতিটি গান আর লোকগাঁথা- সবই বহন করে শত শত বছরের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। সন্দ্বীপের মাটি, মানুষ ও ভাষা এক বিশেষ আঞ্চলিক ঐতিহ্য গড়ে তুলেছে, যা দ্বীপবাসীর জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে জড়িয়ে আছে।
এই দ্বীপে এখনো গ্রামের মোড়ে মোড়ে সন্ধ্যা নামলে গল্প বলে বৃদ্ধরা। যেখানে উঠে আসে দাদা-পরদাদাদের সময়কার সংগ্রাম, প্রেম, বিয়ের রীতিনীতি, এমনকি নদীর গতিপথ বদলের গল্পও। সন্দ্বীপের লোককাহিনি, বাউল ও ভাটিয়ালি গান, পুঁথি পাঠ, আর পল্লীগীতিতে এখনো গ্রামীণ জীবনের সৌন্দর্য, আবেগ ও আশা ধরা পড়ে।
ভাটিয়ালি গান সন্দ্বীপের হৃদয়ে সুর হয়ে বাজে। মাছ ধরার মাঝিরা যখন রাতে নদীতে নেমে পড়েন, তখন নৌকার ছইয়ে ভেসে আসে গান- 'ও নদীরে, তুই যাস কোথায় রে…'। এ গান শুধু সুর নয়, এটি আত্মার ভাষা, এটি শিকড়ের স্পর্শ। সন্দ্বীপের মায়াময় পরিবেশ, নদী, খাল, খেত, নারকেল গাছ, বাঁশঝাড়- সবই যেন এই গানের অনুষঙ্গ।
এ দ্বীপে এখনো বহু তরুণ কণ্ঠে বাঁচিয়ে রেখেছে লোকগান, আঞ্চলিক নাট্যধারা, পল্লী কবিতা ও ধর্মীয় গীত। স্কুল-কলেজে বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, মসজিদ-মাদ্রাসার ইসলামিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মহল্লার নাটক মঞ্চায়ন সব মিলিয়ে সন্দ্বীপের সংস্কৃতির এক ধারাবাহিক ধারা আজও অবিচল।
প্রবাসে থাকা সন্দ্বীপিয়ানরাও নিজেদের শিকড় ভোলেননি। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকা, কানাডা, এমনকি অস্ট্রেলিয়াতেও প্রতি বছর আয়োজিত হয় ‘সন্দ্বীপ উৎসব’। সেখানে গান, কবিতা, স্মৃতিচারণা আর ঐতিহ্যবাহী খাবারের মাধ্যমে তারা সন্তানদের শেখান- 'তোমার শিকড় আছে সন্দ্বীপে'।
এই সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারই সন্দ্বীপবাসীর আত্মপরিচয়। এই সংস্কৃতিই তাদের কাঁদায়, হাসায়, লড়ায় এবং বারবার তাদের ডেকে আনে সেই কাদামাটির ঘ্রাণে মোড়া ছোট্ট এক স্বর্গে।
সন্দ্বীপের সংস্কৃতি শুধু ইতিহাস নয়, এটি এখনো বেঁচে আছে প্রতিটি মানুষের প্রতিদিনের জীবনযাত্রায়। তাদের হাসি-কান্না, গান-কবিতা, উৎসব-পার্বণে। এই ধারাকে বাঁচিয়ে রাখাই এখনকার প্রজন্মের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
শিক্ষার অগ্রগতি ও উন্নয়ন
সন্দ্বীপ একসময় শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল, অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধার অভাব ছিল প্রকট। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে দৃশ্যপট। এখন সন্দ্বীপের প্রত্যন্ত গ্রামেও শিক্ষার আলো পৌঁছে গেছে। অভাব-অনটনের মধ্যেও মা-বাবারা সন্তানদের হাতে বই তুলে দিচ্ছেন। কারণ তারা জানেন- শিক্ষাই ভবিষ্যৎ, শিক্ষাই মুক্তির পথ।
বর্তমানে সন্দ্বীপে একাধিক উচ্চবিদ্যালয়, কলেজ এবং মাদ্রাসা রয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে গড়ে উঠেছে আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অনেক প্রতিষ্ঠানেই আইসিটি, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা চালু হয়েছে। মেয়েদের স্কুলে উপস্থিতি আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে, যা একটি আশাব্যঞ্জক পরিবর্তন।
সন্দ্বীপবাসীর আত্মপ্রত্যয় ও উদ্যোগেই সম্ভব হয়েছে এই অগ্রগতি। প্রবাসে থাকা সন্দ্বীপিয়ানরাও দ্বীপের শিক্ষা উন্নয়নে অবদান রাখছেন। অনেক স্কুল-কলেজের ভবন তৈরি হয়েছে প্রবাসীদের দানে, শিক্ষার্থীদের জন্য দেয়া হয়েছে বৃত্তি ও শিক্ষা উপকরণ।
তরুণ প্রজন্মের মাঝে আজ নতুন স্বপ্ন জেগে উঠেছে। অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে, সরকারি চাকরি পাচ্ছে, বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে শিক্ষকদের নিরলস পরিশ্রম, স্থানীয় নেতৃত্বের ইতিবাচক মনোভাব এবং অভিভাবকদের অক্লান্ত সংগ্রাম।
আজ সন্দ্বীপ শুধু স্বপ্ন দেখে না, সেই স্বপ্ন পূরণের পথও তৈরি করছে। একসময় যে দ্বীপ পিছিয়ে ছিল, আজ সেই দ্বীপই শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত হতে চাইছে আলোকিত ভবিষ্যতের পথে।
আরও পড়ুন: সন্দ্বীপের সঙ্গে ৫০ বছরেও যোগাযোগ না থাকা ‘লজ্জার’: প্রধান উপদেষ্টা
নামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য
সন্দ্বীপের নাম নিয়ে প্রচলিত আছে অনেক গল্প। কেউ বলেন আগে ছিল "শূন্যদ্বীপ", কারণ জনমানবশূন্য ছিল দ্বীপটি। কেউ বলেন 'সোমদ্বীপ', চন্দ্রদেবতা 'সোম' এর নামানুসারে। কেউ বলেন 'স্বর্ণদ্বীপ' উর্বরতার কারণে এই নাম। আবার এক ইউরোপীয় জলযাত্রী বালির স্তূপ দেখে দূর থেকে উচ্চারণ করেছিলেন 'স্যান্ড হিপ', কালের বিবর্তনে যা হয়ে যায় 'সন্দ্বীপ'।
সন্দ্বীপ শুধু একটি নাম নয়, এটি বহন করে শতাব্দীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর প্রজন্মের স্মৃতিচিহ্ন। এই নামের আড়ালে আছে অনেক গল্প, আছে ভাষার বিবর্তন, লোককাহিনি এবং উপমহাদেশের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক ধারা।
প্রাচীনকালে এ দ্বীপটিকে কেউ কেউ ডাকতেন 'শূন্যদ্বীপ'। কারণ একসময় এটি ছিল জনমানবশূন্য, একলা পড়ে থাকা একটি দ্বীপ। এরপর কেউ বলেছিলেন, এর উর্বর মাটির কারণে এর নাম হতে পারে 'স্বর্ণদ্বীপ', যেন সোনার মতো উজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ।
আরেক প্রচলিত মত অনুসারে, চন্দ্রদেবতা ‘সোম’-এর নামে একে “সোমদ্বীপ” বলা হতো। ধীরে ধীরে উচ্চারণ বদলে তা হয়ে যায় সন্দ্বীপ। আবার অনেকে বলেন, ইউরোপীয় পর্যটক ও নাবিকেরা সমুদ্রপথে আসার সময় দূর থেকে দ্বীপটির রূপে মুগ্ধ হয়ে উচ্চারণ করেন ' স্যান্ড হিপ' (বালুর স্তূপ)। কালের প্রবাহে এই নামই রূপ নেয় আজকের 'সন্দ্বীপ'-এ।
আজও কেউ যখন বলেন, 'আমি সন্দ্বীপ্পা', তখন তার হৃদয়ে শুধু একটি ভৌগোলিক অবস্থান নয়, জেগে ওঠে শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্যের অহংকার।
ইতিহাসের আলোকে সন্দ্বীপ
সন্দ্বীপের ইতিহাস শুধুমাত্র একটি দ্বীপের বিবরণ নয়, এটি এক দীর্ঘকালীন সংগ্রাম, সংস্কৃতি আর গৌরবের গল্প। প্রাচীনকালে সন্দ্বীপ ছিল বাণিজ্য ও লবণ উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্র। ১৭৭৬ সালের এক রিপোর্টে দেখা যায়, প্রতিবছর এখানে উৎপাদিত হতো লক্ষাধিক মণ লবণ, যা শত শত জাহাজে করে ছড়িয়ে পড়ত দেশজুড়ে।
এই দ্বীপে সময়ের সাক্ষী হয়ে এসেছেন বহু পর্যটক ও ইতিহাসবিদ। ১৩৪৫ সালে ইবনে বতুতা, ১৫৬৫ সালে সিজার ফ্রেডরিক, এবং ১৯২৯ সালে কাজী নজরুল ইসলাম সন্দ্বীপে এসে এর প্রকৃতি ও মানুষে মুগ্ধ হন। নজরুল এখানেই রচনা করেন তাঁর গীতিনাট্য 'মধুবালা' ও 'চক্রবাক'-এর কিছু কবিতা।
স্বাধীনতা আন্দোলনেও সন্দ্বীপ ছিল সক্রিয়। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ যখন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়, তখন আবুল কাসেম সন্দ্বীপী-র কণ্ঠে এই দ্বীপও হয়ে ওঠে ইতিহাসের অংশ।
প্রশাসনিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সন্দ্বীপ নোয়াখালী থেকে চট্টগ্রামের অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯৫৪ সালে, এবং ১৯৮৪ সালে উপজেলায় রূপান্তর লাভ করে।
সন্দ্বীপের ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়- এই দ্বীপ কেবল একটি ভূখণ্ড নয়, এটি একটি জীবন্ত ইতিহাস, যা গড়ে উঠেছে শ্রম, ত্যাগ ও ভালোবাসার ভিত্তিতে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার বিবর্তন
এক সময় সন্দ্বীপ ছিল মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। যাতায়াত ছিল শুধু নৌপথে। ঝুঁকিপূর্ণ কাঠের নৌকা, ত্রিশ মণ লবণের পাল তোলা ট্রলার কিংবা দিনের পর দিন অপেক্ষায় থাকা খেয়া পারাপার। বর্ষায় তো যাত্রা মানেই ছিল একপ্রকার দুঃসাহসিক অভিযান।
কিন্তু সময় বদলেছে, বদলেছে যোগাযোগের চিত্রও। এখন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া ফেরিঘাট থেকে নিয়মিত ফেরি চলাচল করে সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাট পর্যন্ত। যারা দ্রুত যেতে চান, তারা কুমিরা ঘাট থেকে স্পিডবোটে মাত্র ২০ মিনিটেই পৌঁছে যান দ্বীপে। এছাড়াও সন্দ্বীপে হেলিকপ্টার ল্যান্ডিংয়ের ব্যবস্থাও রয়েছে।
সন্দ্বীপে যাওয়ার প্রধান পথ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হয়ে। বাঁশবাড়িয়া ঘাট থেকে ফেরি করে যেতে লাগে প্রায় ১ ঘণ্টা। তবে সময় বাঁচাতে অনেকে যান কুমিরা ঘাট হয়ে স্পিডবোটে মাত্র ২০ মিনিটে পৌঁছানো যায় দ্বীপে। ঢাকার আব্দুল্লাপুর থেকে সরাসরি বাস আসে, ট্রেনেও আসা যায় সীতাকুণ্ড পর্যন্ত। এমনকি হেলিকপ্টারেও এখন সন্দ্বীপে যাওয়া যায়।
সম্পতি সীতাকুণ্ড-সন্দ্বীপ নৌপথে ফেরি চলাচল শুরু হয়েছিল। বাস, ট্রাক, ট্যাংক লরি, মিনিবাস, প্রাইভেট কারসহ সব ধরনের যানবাহন সরাসরি দ্বীপে পৌঁছানোর সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় সন্দ্বীপবাসীর জীবনযাত্রার মান ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ারও প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। তবে কিছুদিন চলার সেটি আবার বন্ধ রাখা হয়। আশা করা যায় সেটি আবারও চালু হবে।
এই যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন শুধু যাতায়াতের জন্য নয়, এটি সন্দ্বীপের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পর্যটনের জন্যও নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার এই বিবর্তনই সন্দ্বীপবাসীর জীবনযাত্রা ও স্বপ্নকে দিয়েছে নতুন গতি।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও স্বপ্ন
সন্দ্বীপ শুধু অতীত আর বর্তমানের গল্প নয়, এটি ভবিষ্যতেরও প্রতিচ্ছবি। যেকোনো দ্বীপ যেমন প্রকৃতির খেয়ালে ধ্বংস হতে পারে, ঠিক তেমনই পরিকল্পনা ও চেষ্টায় বদলে যেতে পারে এক সমৃদ্ধ আধুনিক অঞ্চলে। সন্দ্বীপের ভবিষ্যৎ তাই এক দ্বিমুখী ধারার ওপর দাঁড়িয়ে। একদিকে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি, অন্যদিকে উন্নয়ন, প্রযুক্তি আর আত্মবিশ্বাসে গড়ে তোলার সম্ভাবনা।
বর্তমানে সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা সন্দ্বীপের দীর্ঘমেয়াদী টেকসই রূপান্তরের দিকে ইঙ্গিত দেয়। নদী ভাঙন রোধে বাঁধ নির্মাণ, বৃক্ষরোপণ, আধুনিক রাস্তা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার পাশাপাশি কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ- এসব পদক্ষেপ ভবিষ্যতের নিরাপদ ও উন্নত সন্দ্বীপের ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে।
একটি বিশাল সম্ভাবনার নাম হচ্ছে পর্যটন। সন্দ্বীপের সমুদ্র সৈকত, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সূর্যাস্ত, ইতিহাস এবং সংস্কৃতি- সব মিলিয়ে একে একটি আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যায়। এখানে ‘ইকো-ট্যুরিজম’ বা পরিবেশবান্ধব পর্যটনের সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল। পর্যটন ব্যবস্থা উন্নত হলে শুধুমাত্র স্থানীয়দের কর্মসংস্থানই বাড়বে না, সন্দ্বীপের প্রতি দেশের মানুষের আকর্ষণও বহুগুণ বাড়বে।