শুরু হলো বাজেট সংশোধন কার্যক্রম, যেভাবে হবে কাটছাঁট

১ দিন আগে
চলতি বছরের বাজেট সংশোধনের কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। নানা ধরনের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে বাজেটকে কাটছাঁট করে সরকারের অর্থ অপচয় কমানোর লক্ষ্যেই মূলত বাজেট সংশোধন করা হয়ে থাকে। অতীতে সাধারণত অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ের পর থেকেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থবিভাগ বাজেট সংশোধনের উদ্যোগ নিতো। তবে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এবার কিছুটা আগেই এই বাজেট সংশোধনের উদ্যোগ নিলো অর্থবিভাগ।

এ ব্যাপারে গত ১৪ নভেম্বর এক পরিপত্র জারি করেছে অর্থবিভাগ। ‘২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট প্রাক্কলন (পরিচালন ও উন্নয়ন) প্রণয়ন’ শিরোনামে এই পরিপত্রে বলা হয়, ’সরকারের অগ্রাধিকার খাতগুলোতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের মাধ্যমে সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো পদ্ধতির আওতায় সকল মন্ত্রণালয় বা বিভাগ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) বাজেট সুষ্ঠু ও সময়মতো বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংশোধিত বাজেট প্রণয়ন করা প্রয়োজন।’

 

চলতি অর্থ বছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বিশাল বাজেট প্রণয়ন করেছিলেন আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এই বাজেট উপস্থাপনের সময়ই অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা এই বাজেটকে অবাস্তব ও বাস্তবায়ন অযোগ্য বলে এর সমালোচনা করেছিলেন। বিশেষ করে রাজনৈতিক বিবেচনায় মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালী নেতাদের নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন প্রকল্পের নামে বাজেটে রাখা হয় বিপুল বরাদ্দ, যার বেশিরভাগই অপ্রয়োজনীয় ও অপচয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

আরও পড়ুন: চলতি বা আগামী মাসে বাজেট পর্যালোচনা করা হবে: অর্থ উপদেষ্টা 

 

বিশেষ করে চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে দেশ যখন ব্যাপক মূল্যস্ফীতিতে আক্রান্ত, রফতানি ও রেমিট্যান্সের প্রবাহ নিম্নমুখী এবং বৈদেশিক রিজার্ভের ভাণ্ডার ফুরিয়ে আসার পথে; ঠিক তখনই তৎকালীন সরকার এত বিশাল পরিসরের বাজেট জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে। এটাকে আত্মঘাতী পদক্ষেপ হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

তবে গণ আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর পাল্টে যায় পরিস্থিতি। এরপর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন যথাক্রমে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ও ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। দেশের এই দুই প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই শুরু করেন বাজেট পর্যালোচনার কাজ।

 

জরুরি ভিত্তিতে শুরু করেন অপচয়মূলক ব্যয় কমানোর কার্যক্রম। তাদের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বাজেট ছাঁটাই করার মতো খাতগুলো চিহ্নিত করার কার্যক্রম হাতে নেয় অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছিলেন, অপচয়মূলক উদ্যোগ বন্ধে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এডিপির আওতায় চলমান ও নতুন উভয় ধরনের প্রকল্পই যাচাই ও বাছাই করবে।

 

এছাড়া মূল্যস্ফীতি কমাতে এবং অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনার জন্য সরকারের ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে উন্নয়ন বাজেট হ্রাস করার কথাও বলেছিলেন তিনি। রাজনৈতিক বিবেচনায় বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় অনেক প্রকল্প নেয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন, একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা নতুন প্রকল্পগুলোর মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো বাতিল করা হবে। এমনকি চলমান যেসব প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ নয়, সেগুলোতে অর্থ ব্যয় করা হোক বা না হোক, সেগুলোও শেষ করা হবে।'

 

এর অংশ হিসেবেই এবার সময়ের আগেই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো বাজেট সংশোধনের কার্যক্রম।

 

সংশোধিত বাজেট প্রণয়নের নীতিমালা

 

সংশোধিত বাজেট প্রাক্কলন প্রণয়নের ক্ষেত্রে বেশকিছু নীতিমালা অনুসরণের কথা বলা হয়েছে অর্থবিভাগের প্রকাশিত বাজেট পরিপত্রে। বিশেষ করে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের আকার অবশ্যই মূল বাজেটে উল্লেখিত মোট ব্যয়সীমার (পরিচালন ও উন্নয়ন) মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে এবং কোনোভাবেই অতিরিক্ত বরাদ্দ দাবি করা যাবে না বলেও উল্লেখ করা হয়েছে নীতিমালায়। একই সঙ্গে উন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে কোনো অর্থ অব্যয়িত থাকবে বলে অনুমিত হলে ওই অব্যয়িত অর্থ কোনোক্রমেই পরিচালন বাজেটে স্থানান্তর করা যাবে না বলেও নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।

 

আরও পড়ুন: নতুন অর্থবছরের বাজেট পাস

 

সরকারের সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও এদের অধীন বিভিন্ন দফতর স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাকে সংশোধিত বাজেটের প্রাক্কলন আগামী ২৮ নভেম্বরের মধ্যে অর্থ বিভাগে পাঠাতে হবে বলেও জানানো হয় পরিপত্রে।

 

পরিপত্রের সারসংক্ষেপ

 

পরিপত্রে বলা হয়, পরিচালন এবং উন্নয়ন বাজেটের আওতায় বিদ্যুৎ, পেট্রোল, অয়েল ও লুব্রিকেন্ট এবং গ্যাস ও জ্বালানি খাতে বরাদ্দ করা অর্থের সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ ব্যয় করা যাবে।

 

পরিচালন বাজেটের আওতায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট স্থাপনা ছাড়া নতুন আবাসিক ভবন, অনাবাসিক ভবন এবং অন্যান্য ভবন ও স্থাপনা খাতে বরাদ্দ করা অর্থ ব্যয় বন্ধ থাকবে। তবে চলমান নির্মাণকাজ ন্যূনতম ৭০ শতাংশ শেষ হয়ে থাকলে অর্থ বিভাগের অনুমোদন নিয়ে ব্যয় নির্বাহ করা যাবে।

 

এছাড়া সব ধরনের মোটরযান, জলযান, আকাশযানসহ সব ধরনের যানবাহন কেনা বন্ধ থাকবে। তবে পরিচালন বাজেটের আওতায় ১০ বছরের বেশি পুরানো যানবাহন প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের অনুমোদন নিয়ে অর্থ ব্যয় করা যাবে। ভূমি অধিগ্রহণ খাতেও পরিচালন বাজেটে বরাদ্দ করা অর্থ ব্যয় বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে পরিপত্রে।

 

পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় সরকারের নিজস্ব অর্থে সব ধরনের বৈদেশিক ভ্রমণ, কর্মশালা ও সেমিনারে অংশগ্রহণও বন্ধ থাকার কথা জানানো হয়েছে পরিপত্রে। তবে অত্যাবশ্যকীয় বিবেচনায় সীমিত আকারে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে এ সংক্রান্ত গত ৪ জুলাই অর্থ বিভাগের জারি করা পরিপত্র অনুযায়ী বিদেশ ভ্রমণ করা যাবে।

 

রাজস্ব ও মূলধন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সাধারণভাবে বিগত দুই অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের এবং চলতি অর্থবছরের প্রথম ৪ বা ৫ মাসের রাজস্ব আদায়ের ধারা বিবেচনা করে এর ভিত্তিতে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত প্রাক্কলন প্রস্তুতের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে পরিপত্রে। একইভাবে পরিচালন ব্যয়ের সংশোধিত প্রাক্কলনের ক্ষেত্রে, বিগত দুই অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের এবং চলতি অর্থ বছরের প্রথম ৪/৫ মাসের প্রকৃত ব্যয়ের ধারা বিবেচনায় নিয়ে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত প্রাক্কলন প্রস্তুতের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

 

আরও পড়ুন: প্রস্তাবিত বাজেটে কিছুই পায়নি পুঁজিবাজার!

 

পাশাপাশি বেতন ভাতা খাতে ব্যয়ের হিসাব প্রণয়নে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের প্রকৃত ব্যয়ের হিসাব বিবেচনায় নিয়ে সংশোধিত প্রাক্কলন প্রস্তুতের নির্দেশনা দেয়া হয়। 

 

এছাড়া সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) প্রণয়নে ১৩টি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সংশোধিত এডিপিতে প্রকল্প সংখ্যা সীমিত রাখা, এলাকা ও অঞ্চলভিত্তিক সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে গৃহীত প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ প্রদান নিশ্চিত করা, ধীরগতির প্রকল্প থেকে বরাদ্দ কমিয়ে দ্রুত বাস্তবায়ন গতির গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ দেয়া, বরাদ্দের ক্ষেত্রে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, কৃষিভিত্তিক শিল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন সম্পর্কিত প্রকল্পের অগ্রাধিকার, মূল সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দহীন কোনো প্রকল্প না রাখা ইত্যাদি।

 

পাশাপাশি সরকারের কৌশলগত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের আলোকে অগ্রাধিকার বাছাই করে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাদ দেয়া এবং সংশোধিত এডিপির মূল অংশে বরাদ্দবিহীন কোনো প্রকল্প না রাখার ব্যাপারেও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে পরিপত্রে।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন